Home সর্বশেষ প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা সোনা ব্যাঙ

প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা সোনা ব্যাঙ

তাসনিম তাবাসসুম
৫৭ views

বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়তেই মাঠের কোণে গলা ফুলিয়ে, সুরে সুরে মুখ তুলে ডাকতে শুরু করে একদল ব্যাঙ। ঝুম বর্ষায় সারাদিন-সারারাত ধরে সদলবলে ডাকতে থাকে। প্রজননের জন্য সঙ্গী খুঁজতে এই ব্যাঙের ডাক যেন এক প্রাকৃতিক অর্কেস্ট্রা! কেউ এদের বলে ‘সোনা ব্যাঙ’ কেউ ‘ভাউয়া ব্যাঙ’ কেউ ‘কোলা ব্যাঙ’, ‘হোলা ব্যাঙ’ আবার কেউ বলে ‘বুল ফ্রগ’। তবে সোনা ব্যাঙ শুধু শব্দশিল্পীই নয়, ফসল ও কৃষকের বন্ধু; পরিবেশের দারুণ রক্ষাকর্তা। চলুন, জানি এই রঙিন উভচরের গল্প।

সোনা ব্যাঙ আন্তর্জাতিকভাবে ইন্ডিয়ান বুল ফ্রগ, টাইগার ফ্রগ বা গোল্ডেন নামেও পরিচিত, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য উভচর প্রাণী। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hoplobatrachus tigerinus, তবে পূর্বে এটি Rana tigerina নামে পরিচিত ছিল।

ইন্ডিয়ান বুলফ্রগ (Hoplobatrachus tigerinus) মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে দেখা যায়। এদের প্রধান আবাসস্থল ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার। আফগানিস্তান ও ভুটানের কিছু অংশেও এদের পাওয়া যায়।

এরা সাধারণত ধানক্ষেত, পুকুর, খাল ও জলাভূমিতে বিচরণ করে। প্রজননের মৌসুম হওয়ায় বর্ষাকালে এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। জলাভূমিতে, স্থায়ী জলের কাছাকাছি গর্ত এবং ঝোপঝাড়েই এদের বাসস্থান। বছরের অধিকাংশ সময় এরা লুকিয়ে থাকে। 

বুলফ্রগ সাধারণত সবুজাভ বা বাদামী-সবুজ রঙের হয়। পুরুষ ব্যাঙের চোয়ালের দুই পাশে গাঢ় নীল বা কালচে বর্ণের দুটি স্বরথলি থাকে, যা ফুলিয়ে উচ্চস্বরে ডাক দেয়। এই ডাকেই প্রজননের জন্য স্ত্রী ব্যাঙ আকৃষ্ট হয়। স্ত্রী ব্যাঙের কিন্তু কোনো স্বরথলি হয় না। বর্ষাকালে এদের বাহ্যিক রূপ ও আচরণ উভয়েরই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। 

2 9

প্রজননের সময় পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙকে জড়িয়ে ধরে ২-৩ ঘণ্টা পানিতে ভেসে থাকে, ছবি: রিসার্চ ম্যাটার্স

প্রজনন ঋতুতে বর্ষায় পুরুষ ব্যাঙেরা রং বদলায়। সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে পুরুষ বুলফ্রগ-এর শরীর উজ্জ্বল সবুজাভ সোনালী রঙে রূপান্তরিত হয়। স্ত্রী ব্যাঙকে আকর্ষণের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তবে স্ত্রী ব্যাঙ সারা বছরই হালকা ধূসর বর্ণের থাকে। উভয় লিঙ্গের শরীরে একটি হলুদাভ সোনালী পৃষ্ঠীয় দাগ মুখ থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে, এই দাগ দেখেই তাদের সহজেই শনাক্ত করা যায়। 

বর্ষাকালকে বলে সোনা ব্যাঙের প্রেমের মৌসুম। মেঘলা আবহাওয়া ও বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া অগভীর জলাশয় বা ধানের ক্ষেতে এদের প্রজননের জন্য সম্মিলনের উপযুক্ত স্থান। ভরা বর্ষায় পুরুষ ব্যাঙ ডাক দিয়ে স্ত্রী ব্যাঙের মনোযোগ আকর্ষণ করে। একবার কোনো পুরুষ ব্যাঙ কোনো স্ত্রী ব্যাঙের সঙ্গী হলে, অন্য পুরুষ ব্যাঙের জন্য তাদের জোড়া আলাদা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রজননের সময় পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙকে জড়িয়ে ধরে ২-৩ ঘণ্টা পানিতে ভেসে থাকে। এরপর স্ত্রী ব্যাঙ ডিম্বাণু ছাড়ে ও পুরুষ ব্যাঙ তাতে শুক্রাণু নিঃসরণ করে। পানিতে নিষেকের মাধ্যমে এদের প্রজনন ঘটে। এই প্রক্রিয়া বহিঃনিষেক (external fertilization) নামে পরিচিত। ডিম থেকে ব্যাঙাচিতে রূপ নিতে সময় লাগে প্রায় ৩০-৩৫ দিন। একেকটি স্ত্রী ব্যাঙ একবারে ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। এজন্যেই সোনা ব্যাঙ যেখানেই দেখা যায়  এরা সংখ্যায় থাকে অনেক বেশি। 

সোনা ব্যাঙ নিশাচর, সাধারণত এরা একাকী চলাফেরা করে। শীতকালে এরা হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রায় চলে যায়, যেখানে ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে এদের দেহের কার্যকলাপ ন্যূনতম পর্যায়ে চলে আসে। খাবার গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন এরা মাটির নিচে গর্তে নিশ্চল হয়ে থাকে।

ইন্ডিয়ান বুলফ্রগের প্রাকৃতিক শত্রুর তালিকায় রয়েছে নানা ধরনের প্রাণী। জলের কাছাকাছি থাকা সাপ, বিশেষ করে পানিতে বসবাসকারী প্রজাতিগুলো, যেমন জলসাপ, এদের শিকার করে। পাখিদের মধ্যে বক, সারস, মাছরাঙা ও কাক এই ব্যাঙ খেয়ে থাকে। কিছু অঞ্চলে, বিশেষত ভারতে নেপালে ও বাংলাদেশের মানুষও এটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যদিও এটি অনেক স্থানে বেআইনি। এছাড়াও, শেয়াল, বেজি এবং ছোট বন্য বিড়ালের মতো মাংসাশী প্রাণীরাও সুযোগ পেলে এই ব্যাঙ খেয়ে থাকে।

3 4

স্ত্রী ইন্ডিয়ান বুল ফ্রগ, ছবি: রাউন্ড গ্লাস সাস্টেইন

ইন্ডিয়ান বুলফ্রগ সাধারণভাবে বিষাক্ত নয়। এটি মানুষ বা বড় প্রাণীদের জন্য কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক তৈরি করতে পারে না। এরা ধানক্ষেত ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষিতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে মশা, মাছি এবং তাদের লার্ভা খেয়ে রোগবাহী জীবের বিস্তার রোধ করে। এর বিপরীতে ব্যাঙ নিজেও অনেক বড় প্রাণীর খাদ্য হিসেবে খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

আগে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে এই প্রজাতির ব্যাঙ ব্যাপকভাবে দেখা গেলেও বর্তমানে তা অনেক কমে এসেছে। বাসস্থান ধ্বংস, রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার, এবং খাদ্য ও রপ্তানির উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত শিকার এই হ্রাসের প্রধান কারণ। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসইএন  একে ‘নূন্যতম বিপদগ্রস্থ (Least Concern)’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের আওতায় একে ‘সংরক্ষিত প্রাণী’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

ইন্ডিয়ান বুলফ্রগ বা সোনা ব্যাঙ গ্রাম-বাংলার বর্ষার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় সেই সাথে পরিবেশ ও কৃষির উপকারেও আসে। বৈচিত্র্যময় এই প্রাণীটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা, প্রাকৃতিক বাসস্থান সংরক্ষণ এবং অপ্রয়োজনীয় নিধন ও রপ্তানি বন্ধ রাখা। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এই নিঃশব্দ সহচরদের বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র: এমফিবিয়ান ওয়েব ও আইইউসিএন রেড লিস্ট

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ