দিবারাহ মাহবুব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ক্রাঁতি’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার ও সুনাম কুড়িয়েছে। বার্সেলোনা ফিল্ম এক্সপেরিয়েন্স (২০২৫)-এ দিবারাহ মাহবুব “Best First Time Filmmaker” পুরস্কার জিতেছেন, যা তার প্রতিভা ও সৃজনশীলতার স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়াও, সিনে প্যারিস ফিল্ম ফেস্টিভাল ২০২৬-এও তিনি একই বিভাগে মনোনীত হন। অন্যদিকে, নাটোলিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ২০২৫-এ চলচ্চিত্রটির অভিনয়শিল্পী অর্ণা “Best Actor Female” বিভাগে মনোনীত হয়েছেন, যা তার অভিনয় দক্ষতার প্রতি এক সম্মানজনক স্বীকৃতি।
এই সাফল্যের মধ্যেই পরিচালক দিবারাহ মাহবুব এবং অভিনয়শিল্পী অর্ণা ‘ক্রাঁতি’ চলচ্চিত্র নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন হ্যালো বাংলাদেশ- এর সঙ্গে। এই একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে চলচ্চিত্রটির পেছনের গল্প, নারীদের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার নানা দিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুপ্রভা জুঁই
প্রথমেই শুভ কামনা জানাচ্ছি। ‘ক্রাঁতি’ আন্তর্জাকিভাবে সন্মানিত হচ্ছে। এটাই কি আপনার প্রথম ফিকশনধর্মী চলচ্চিত্র?
জ্বি, ফিকশন হিসেবে এটাই আমার প্রথম কাজ। তার আগে আমি কিছু প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে কাজ করেছি। পেশাগতভাবে যেহেতু দীর্ঘসময় হিউম্যানিটারিয়ান সেক্টরে কাজ করেছি তাই আন্তর্জাতিক এনজিও’র সাথে জর্ডানে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এরপর থেকে প্রামাণ্যচিত্রের দিকেই আমি বেশি ঝুঁকে পড়ি। লন্ডনের ফেলোশিপটা (Chevening Scholarship on Visual Anthropology) আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছে। সেকারণেই এই ফিকশনের দিকে আসা।
‘ক্রাঁতি’ চলচ্চিত্র নির্মাণের পিছনে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
আমি আসলে এক জোড়া বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে গল্প বলতে চাচ্ছিলাম। আধুনিকতা আর পুরনো রীতিনীতির দ্বন্দ্বে, একজন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী আর তার সাহসী গৃহকর্মীর জীবন কোথায় এসে যেন একসাথে জড়িয়ে যায়। দুজনেই তাদের নিজের অধিকার আর সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করে চলেছে এমন একটা সমাজে যেখানে পুরুষদের আধিপত্য বেশি। তাদের জীবনযাত্রা আলাদা হলেও সংগ্রামের গল্পটা কিন্তু একই। এই দুইটা ইন্সটিটিউশনের মাঝে যে দ্বন্দ্ব সেই গল্পটাই মূলত আমি বলতে চেয়েছি। ঘরের মাঝের যে পরিবেশ সেগুলোকে ধরেই এই গল্পটা বুনন করা হয়েছে।
এটা কি তাহলে কোনোভাবে সামাজিক শ্রেণির সাথেও সম্পর্কিত?
ঠিক তাই। আসলেতো একটা শ্রেণির মাঝেই অনেকগুলো বিভাজন থাকে। তবুও আমি চেষ্টা করেছি শ্রেণির সাথে পিতৃতন্ত্রের সমীকরণটা নিয়ে কাজ করতে। আমি লেখক বলে গল্পটা আমি যে শ্রেণিতে থাকি সেখান থেকে এসেছে। তাই আমার এমন কোনো দাবী নেই যে ওদের গল্পটা আমি জানি। কিন্তু যতটা কম্প্যাশনের সাথে বলা যায় আমি সেটাই চেষ্টা করেছি। যেমন গল্পটা লেখার সময় আমার বাসায় যে সাহায্য করে তার সাথে কথা বলেছি। এনজিওতে কাজ করার সময় মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে যেয়েও মানুষের সাথে অনেক কথা বলেছি, অনেক সময় কাটিয়েছি। আমাদের মনে রাখতে হবে গল্প অথেনটিক হয় বা সত্যভাব ধরে রাখতে পারে যখন আমাদের যে কথাগুলো আছে সেগুলোকে আমরা তুলে ধরতে পারি।
চলচ্চিত্রটি আমার দেখা নেই তাই জানতে চাচ্ছি, আপার-ক্লাস মানেই প্রগ্রেসিভ আর লোয়ার-ক্লাস মানেই নন-প্রগ্রেসিভ এমন ধারণার কোনো প্রতিফলন আছে কি?
না, এরকম জায়গা থেকে কিন্তু আমি গল্পটা বলছিনা। কারণ তাহলে আর বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে কাল্পনিক লেখাটা হতো না। পিতৃতন্ত্র ও নারীবাদ যদি রাষ্ট্র কাঠামোয় একসাথে বিরাজ করতে পারলে এই এই দ্বন্দ্বটা হতো না। আমাদের মনে হয় যে, এডুকেটিভ ক্লাস আর নন-এডুকেটিভ ক্লাসের মাঝেই কেবল দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু এডুকেটিভ ক্লাসের মাঝেও তো অনেক রক্ষণশীল মনোভাব দেখা যায়। একই ঘর, একই ক্লাস এমনকি একই ফ্রেন্ডগ্রুপেই এই বিভেদ আছে। তাই আমি আসলে জেনারাইলেশনের চাইতে বরং বৈচিত্র্যতার জায়গায় বেশি ফোকাস করতে চেয়েছি।
চলচ্চিত্রের নাম ‘ক্রাঁতি’ কেন হলো?
আমি যখন গল্পটা লেখা শুরু করি তখন একটা নাম ছিলো, সমান্তরাল। কিন্তু পরে আমি দেখলাম যে এ নামে একটা সিনেমা হয়েছে, দোকানও আছে। যেহেতু এটা আমার প্রথম চলচ্চিত্র তাই নামের প্রতি বিশেষ যত্ন ছিল। এরমাঝে জুলাই আন্দোলন শুরু হয়। সেসময় আমাদের সবার জীবনে এমনকি আমাদের দেশটাও একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তখন শব্দ খুঁজতে যেয়ে ক্রাঁতি শব্দটা আমার খুব ভালো লাগেলো। একটা রূপান্তরের এসেন্স থেকেই এই শব্দটাকে বাছাই করা হয়েছে।
আপনার গল্পের সাথে জুলাই আন্দোলন কীভাবে সম্পর্কিত?
‘ক্রাঁতি’ ১৫ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। জুন, ২০২৪ থেকে যার নির্মাণের মহড়া শুরু। জুলাই আন্দোলনের সময় এবং এরপরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর শুটিং চলে। নভেম্বরের মাঝে পুরো নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ফলে গল্পটা লেখা শুরু করি আন্দোলনের অনেক আগে। এরকম কিছু যে হবে আমরা তো জানতাম না। তাই জুলাই আন্দোলন আমার গল্পের একটা ব্যাকড্রপ হিসেবে আমি দেখিয়েছি। সেখানে আন্দোলনের শুরু, মধ্যবর্তী সময় ও আন্দোলন পরবর্তী কিছু সময়কাল আমার চলচ্চিত্রে দেখতে পাবেন। তাছাড়া আমার ব্যাকগ্রাউন্ড যেহেতু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে তাই এই সময়টাও আমাকে খুব উজ্জীবিত করেছিলো। আমার কাজের মধ্য দিয়ে জনমানুষের উত্থানকে আমি সম্মান জানাতে চেয়েছিলাম।
‘পরিচালক’ ও ‘নারী পরিচালক’ এই টার্মগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সত্যি বলতে এই পরিচয়টা খুবই নতুন আমার জন্য। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়ার যায়গায় আমি এখনো খুব আনাড়ি। বলতে পারেন এখানেও একটা ক্রাঁতি চলছে (হাসি…)। ছোটবেলা থেকেই এটা আমার স্বপ্ন ছিলো। আমার পড়াশুনা কাজ একদম ভিন্ন মাধ্যমে হয়েছে। এই জগতের কাউকে চিনিনা। এরমাঝেই ছোটখাট একটা ফিল্ম বানাতে পেরেছি। সেটা দেখছি আবার বেশকিছু পুরষ্কারও পাচ্ছে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব এম্পাওয়ারিং। আমার ইনার-চাইল্ড এই ঘটনায় খুবই খুশি। এখানে কোনো জেন্ডারের প্রশ্ন আসছে না তাই।
‘পরিচালক ও ‘নারী পরিচালক’, আমি জানি এই দুইটা টার্ম নিয়ে নানান কথা আছে। আমি উভয় মতবাদকেই সমর্থন করি। তবে বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী নারী নির্মাতার পরিচয়টা এসে যায় কারণ ঘটনাটা আনকমন। সত্যি বলতে কতজন নারী পরিচালককে আমরা চিনি বলেন তো? বড় বড় সিনেমার নাম করলেই পুরুষ পরিচালকদের নামগুলো ভেসে ওঠে। তাই এই পরিচয়ের যুক্তিটা আমি বুঝি। তবে আমি মনে করি আগামী পাঁচ-দশ বছরের মাঝে এটা অপ্রাঙ্গিক হয়ে যাবে। তখন মানুষজনের মাঝ থেকেই প্রশ্ন আসবে যে, ‘নারী’ বলার দরকার কি?
নারী সদস্যদের একটি টিম নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? এই সিদ্ধান্তটি কীভাবে চলচ্চিত্রের গল্পকে আরও শক্তিশালী করেছে বলে আপনি মনে করেন?
সবাই নন, তবে বেশিরভাগ সদস্য নারী ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুরুষদের কাছ থেকেও এসেছে, এটা আমি পরিস্কার করতে চাই। সকলের অংশগ্রহণেই কাজটি হয়েছে। আমাদের প্রডাকশন তো অনেক ছোট। ডেইলি-ক্র্রু ছাড়া বেশিরভাগ কাজে মেয়েরাই ছিল। আমি চাচ্ছিলাম আরো মেয়ে নিতে। বিশেষ করে আমার সিনেমাটোগ্রাফার ও এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মেয়ে হোক এটা আমি খুব করে চাচ্ছিলাম। কিন্তু এই অঙ্গনে নতুন বলে আমি আসলে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। মেয়েদের একটা দল নিয়ে কাজ করে চাওয়ার কারণ নিশ্চিতভাবেই এমন একটা সঙ্গ নিয়ে কাজ করতে আমার স্বস্তি হয়। আমার যেটুকু পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে সেখানে আমি দেখেছি যে অভিজ্ঞ নারীদের লিডারশিপ নিতে পুরুষদের সমস্যা হয়। অবশ্যই এটা সব পুরুষদের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এরকমটা ঘটেছে।
এই সময়ে এসে নারীদের গল্পগুলো কেন মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠছে না বলে আপনি মনে করেন?
আসলে বাংলাদেশ এতটাই আনপ্রেডিক্টেবল একটা দেশ যে কোনো মন্তব্য করা কঠিন। মানুষজন যদি ‘নারী পরিচালক’ হিসেবে পরিচিতি দেয় এটা খারাপ জিনিস না। কারণ পরিচালকদের স্তরে যেতে নারীদের অনেক বাঁধা আছে। আমি যে এমন ছোট প্রডাকশন করে ফেস্টিভ্যালে যেতে পেরেছি এর পিছনে আমার সৌভাগ্য কাজ করেছে। অর্থাৎ, এমন না যে কোনো সিস্টেমেটিক প্রক্রিয়া আছে অনুসরণ করার মতো। এমনকি এখনো বড় কোনো প্রডাকশন করার মতো এক্সেস আমার নাই যদিও আমার বর্তমান পরিচয় আমি একজন অ্যাওয়ার্ড উইনিং পরিচালক। তাই আমাকে যদি এখন আয়নাবাজি স্তরের ফিল্ম বানাতে হয় তাহলে সেটা অনেক কঠিন হবে। যদি আমি রক্ষণশীল মেজাজের হই তাহলে একজন পুরুষের চাইতে আরো বেশি সমস্যার সম্মুখীন আমাকে হতে হবে। আবার মনে হতে পারে যে, কোনো মেয়ে বুঝি নাই ফাঁকা মাঠ। কিন্তু পরতে পরতে একজন নারীর যে কত বাঁধা আছে সেটা কেউ চিন্তা করতে পারে না। তারা শুধু এটুকুই দেখে যে বাসে মেয়েদের জন্য সিট খালি।
‘ক্রাঁতি’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তা আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করছে?
আমার ছবি যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত সম্মান পেয়েছে এটা সত্যি অনেক আনন্দের। আমরা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি জুলাই আন্দোলনের সময়। যেহেতু এটার সাথে একটা গ্র্যান্ট জড়িত ছিল তাই দেরি করার কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের দেশের মেয়েদের নিয়ে একটা সিনেমা বাইরে ওরা দেখতে চেয়েছে এবং প্রশংসা করেছে এটা সত্যি খুব সম্মানের। আমি প্রথমবার পরিচালনা করছি। অর্ণা প্রথম অভিনয় করছে, পালামার খুব সামান্য স্টেজ অভিজ্ঞতা আছে। এই সামান্য অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্বেও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে ওরা যে ফলাফলটা বের করতে পেরেছে এই সফলতার ভাগিদার তাই সবাই। আমি গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছি। কিন্তু আমার বাংলাদেশের উপর অভিমানও আছে। যতকিছুর মধ্য দিয়ে আমাকে এই সিনেমাটা নির্মাণ করতে হয়েছে সেখানেতো বাংলাদেশ আমাকে সাহায্য করেনি। কিন্তু আর্টিস্টরা কষ্ট করে কিছু অর্জন করলে তখন কিন্তু বাংলাদেশের ক্রেডিট ঠিকই থাকে, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্রেডিট থাকে। এটা বলতে আমি ভয় পাইনা কারণ আমি নিজে এই জায়গায় এসেছি। আমাকে কোনো মিডিয়া বা প্রডিউসার কারো সাহায্য নিতে হয়নি।
বাংলাদেশে কি এই চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে?
হ্যাঁ, একটা পাব্লিক স্ক্রিনিং হয়েছে। আর কিছু প্রাইভেট স্ক্রিনিং হয়েছে। মনে হচ্ছে আগামী বছরটা এই সিনেমাটা নিয়ে আমাকে ঘুরতে হবে। অনেকেই দেখতে চাচ্ছে। আমি সেজন্য খুবই সম্মানিত বোধ করছি। আমি চেষ্টা করছি হিল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সাথে কোলাবরেট করতে যেন স্ক্রিনিং করতে পারি। তাছাড়া ওদের কাজের দর্শন আমার ভালো লাগে। যদি আমাদের দেশ থেকে আমাকে অফার করে আমি এটাও বিবেচনা করবো।
পাব্লিক স্ক্রিনিং এর টিকেট সোল্ড আউট ছিল জেনেছি। সেখানে দর্শকদের অভিব্যক্তি কেমন ছিল?
আমি আসলে কখনও ভাবিনি এটা সোল্ড আউট হলেও মানুষজন মাটিতে বসে দেখবে বা টিকেট নেই জেনেও অনেকেই টিকেটের খোঁজ করবে। এটা আসলে আমি কখনো কল্পনাই করিনি। মানুষের এমন উপস্থিতি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছিল। আর অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। দুইজন পুরুষ দর্শক এসে আমাকে জানিয়েছিল যে ওরা সিনেমাটার বক্তব্যের সাথে নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে। এটা মনে রাখার মতো একটা ঘটনা। এতজন মানুষের মনে যে মুভমেন্ট ঘটাতে পেরেছি এটাতেই আমার নিজেকে সফল মনে হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন আপনি অংশগ্রহণ করলেন তখন অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্রে সেদেশের সংস্কৃতির সাথে আমাদের অবস্থান কোথায় বলে আপনার মনে হলো? মানে নারীর ইস্যুটা কি বৈশ্বিক নাকি কেবলই বাংলাদেশেই বেশি মনে হয়?
নানাদেশ থেকে নানারকমের নারীকেন্দ্রিক সিনেমা আসছে এবং এগুলোর সংখ্যাও বাড়ছে। দেখুন হলিউড স্বয়ং একটা পুরুষশাসিত জায়গা। আশ্চর্যজনকভাবে নারী নির্মাতারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকেই বেশিরভাগ উঠে এসেছেন। এবং তাদের কাজগুলোও অসম্ভব সাড়া জাগানো। কিন্তু আমাদের এক্সপোজ বেশি আমেরিকান সিনেমার দিকে আর কিছু বৃটিশ। এজন্য আমাদের ধারণা কম আসলে। কিন্তু আমেরিকার সিনেমা অঙ্গন ভীষণভাবে পুরুষশাসিত। আমি নিজেও আমেরিকায় থেকেছি। ওদের ইন্সটিটিউশনগুলিও বেশ পুরুষশাসিত। বিশ্বজুড়ে নারী নির্মাতাদের কাছ থেকে আমরা অনেক নুয়ান্সড ফিল্ম অনেকদিন ধরেই পাচ্ছি। যেমন ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্র নির্মাতা এগনেস ভার্দা সেই ষাটের দশক থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে আসছেন। উনি বছর খানেক আগে মারা গিয়েছেন।
এখনো নারী নির্মাতা খুব কম কিন্তু দেখেন এই বছর ইন্ডিয়া থেকে নারী নির্মাতারা কেমন ছক্কা হাঁকাল! ‘অল উই ইমাজিন এজ লাইট’, ‘গার্লস উইল বি গার্লস’ থেকে শুরু করে গত বছরের ছবি ‘লাপাতা লেডিস’। খেয়াল করলে দেখবেন গ্লোবাল নমিনেশন নারী নির্মাতাদের কাজগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। ‘অল উই ইমাজিন এজ লাইট’ কানের সর্বোচ্চ সম্মান জিতেছে যেটা ইন্ডিয়াতে প্রথম। সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত পাননি। নারীরা এগিয়ে আসছে তাই বৈশ্বিকভাবে নারীদের গল্পগুলোও উঠে আসছে বলে আমি মনে করি। একেকজনের গল্প একেকরকম তাই এই গল্পগুলো বলার মাঝে বৈচিত্র্যতা তৈরি হয় যেটা খুব সুন্দর। তাই যখন ভিজুয়াল স্পেসে ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে নারীরা নিজেদের গল্পগুলোকে প্রকাশ করতে পারে তখন ভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম আমরা দেখতে পারবো যেগুলো পুরস্কারও জিতবে।
চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রে আছেন তাসনিম ইসলাম অর্ণা ও পালামা আহমেদ। তাদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অর্ণাকে আগে থেকেই চিনতাম তাই ওর থাকাটা আমার জন্য স্বস্তিকর ছিল। পালামাকে আমি আগে চিনতাম না ফলে এই জার্নিটা খুব নতুন ছিল। আমাকে সে অনেকভাবে টেস্ট করেছে। আমিতো আগে কখনও পরিচালনা করিনি তাই আমার কাজটা কতটা ঠিক হচ্ছে সেটাও বুঝতাম না। ব্যাপারটা অনেকখানি এক্সপেরিমেন্টের মতো। কিন্তু আমার কলাকুশলীদের আমি সেটা বুঝতে দেইনি (হাসি…)।
আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজটা করেছি। অবশ্যই কিছু রিসার্চ এবং পড়াশুনা আগে করে নিয়েছিলাম। যতটুকু হিউম্যান সাইকোলজি বুঝেছি সেভাবে ওদেরকে গাইড করার চেষ্টা করেছি। গোটা বিষয়টাই কাজ করেছে কারণ আমার উপরে ওদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। আমার মনে হয় ওরা শিক্ষিত নারী হওয়ায় ব্যাপারটা সহায়ক ছিল। ওরা যে আমার উপর ভরসা করেছে, ওদেরকে ডিসিপ্লিন করতে দিয়েছে এই কারণেই সিনেমাটা নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ অভিনয় শিল্পী একজন পুরুষ। কিন্তু পারফর্মেন্সের দিক থেকে যত কমপ্লিমেন্টস আমাদের নতুন অভিনয় শিল্পীরা কুড়িয়েছেন। বিশেষ করে পালামার কথা বলতে হয়। কারণ ওর যে ব্যক্তিত্ত্ব, যে দুনিয়ায় ও বসবাস করে তার চাইতে ওর চরিত্র পুরোপুরি আলাদা। ও কখনো চা বানিয়েও খায়নি। আমি ওকে শিখিয়েছি কীভাবে চা বানাতে হয়। এই ছিল আমাদের প্রক্রিয়া। অর্ণা মনে হয় তুমি এনিয়ে আরো কিছু যুক্ত করতে পারো। আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা দিনদিন বন্ধুর মতো হয়ে উঠছে।
অর্ণা: আমার মনে হয় আমাদের টিমটা আমাদের জন্য একটা আল্টিমেট সেফ স্পেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ জুলাই আন্দোলন শেষের দিকে আমরা শ্যুটটা করেছিলাম। দিবারাহ আপু আসলে উনার সম্পূর্ণটা দিয়ে আমাদের সাপোর্ট করেছেন। শ্যুটিং এর মুহূর্তগুলোতে আমরা বুঝতে পারতাম যে আমরা ভিন্ন একটা জগতে চলে এসেছি। আমাদের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা অনেক সহজ হয়েছিল কারণ নিজেদেরকে প্রকাশ করার যে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তা দিবারাহ আপু আমাদেরকে দিতে পেরেছিলেন।
আমার কোনো ধরনের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা না থাকলেও এটা আমার জন্য সেরা অভিনয়ের মুহূর্তগুলোর একটি হয়ে থেকে যাবে। আমাদের জীবনের সবার জন্যই একটা রূপান্তরের সময় যাচ্ছিলো জুলাইয়ে। আর এখন এই যে সবার সাথে সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্য দিয়েও যেন সেই রূপান্তরটা বয়ে চলেছে
বলে মনে হয়।
টিম মেম্বারদের সাথে এক হয়ে এখনো যে এই জার্নিটা চলছে আমার মনে সেটাই অন্যতম কারণ যে প্রতিটা দিন আমরা নতুন নতুন মাত্রা আমাদের অভিজ্ঞতায় যুক্ত করতে পারছি। আমরা যে এটা পর্যবেক্ষণ করতে পারছি, এই সুযোগটার প্রতি তাই আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। জুঁই আপুর প্রশ্নগুলো শুনেও মনে হচ্ছিল যে আমাদের জন্য অনেক দুয়ার খুলে যাচ্ছে। কারণ একজন নারীর চিন্তাধারাকে তুলে ধরার জন্য যে সংলাপের প্রয়োজন তার ভিতরে আমরা যেতে পারছি। চলচ্চিত্র আসলে আমাদের সবগুলো ইন্দ্রিয় নিয়ে কাজ করতে পারে। তাই একটা গল্প বলে অন্যের মাঝে সেই ভাবের বিনময় ঘটাতে পারাটা আমার মনে হয় দারুন এক যোগাযোগ।
হ্যাঁ, আমি চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য মুখিয়ে আছি।
দিবারাহ: অনেক ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ! আমি বাকরুদ্ধ!
অর্ণা: ও! অনেক ধন্যবাদ আপু!
চলচ্চিত্র বানানোর পরে সেটাকে নিয়ে এত জায়গায় ঘুরে বেড়ানো এবং কথা বলা, তারপরেও আপনারা ক্লান্ত নন। আমি জানি যে আজকেই আপনাদের অনেকগুলো মিটিং ছিলো। ফলে আপনাদের ডেডিকেশন নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। চলচ্চিত্র নির্মাণের পর সেটা নিয়ে ফেস্টিভ্যালে ঘোরার অভিজ্ঞতাটা যদি বলতেন।
এই স্টেজে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ারও অনেক রাস্তা আছে সেইটা আমরা এবারে আবিস্কার করলাম। যেমন এই ফিল্মটা হতে পারলো কারণ একটা ছোট গ্র্যান্ট ফেলোশিপ ছিল। এখানে এপ্লাই করে আমি ফেলোশিপটা পেয়েছিলাম। আমাদের কিছু মেন্টরশিপ ছিল তাই বাঁধা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এমন প্রোগ্রাম যদি আরো হয় যেমন ইউএনডিপি কিছুদিন আগে করেছিল, ইউএন উইমেন করেছিল। এরকম প্রতিযোগিতা যদি আরো হয় এবং তারা প্রোডাকশন ও আর্টিস্টদের জন্য যদি ফান্ড দেয় তাহলে খুবই ভালো হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাকে কিন্তু ইনভেস্ট করতে হয়েছে। অর্ণাও কিছু ইনভেস্ট করেছে। ফেস্টিভ্যালের পার্টিসিপেশন ফি খুবই ব্যয়বহুল। শেষমেশ প্রোডিউসারের ব্যারিয়ারটাই সব। আমাদের দেশেও হয়তো অনেকে থাকবেন যারা এরকম প্রজেক্টে ফান্ডিং করতে চান। তাই বিভিন্ন অর্গানাইজেশন থেকে এবং কালচারাল মিনিস্ট্রিরও যদি এমন কিছু প্রোগ্রাম করতে পারে তাহলে খুব ভালো হয়।
এখন কোনো প্রজেক্ট নিয়ে ভাবছেন?
কিছু চিন্তা আছে। একটা গল্প মাথায় আছে। কিছুটা লেখাও শুরু করেছি। আশা করছি সেরকম সুযোগ আসলে এটা নিয়েও কাজ করা শুরু করবো।
আশা করছি প্রথম কাজের চ্যালেঞ্জগুলো আগামী কাজে কমে আসবে। শুভ কামনা রইলো।
সেটাই আশা করছি। তবে না হলেও সমস্যা নাই। এটা একটা লম্বা যুদ্ধ।