সম্প্রতি বাংলাদেশ তোলপাড় করা একটি খবরের পেছনে যিনি কলকাঠি নেড়েছেন, তাকে অন্তর্জাল চেনে অন্যভাবে। অন্তর্জালে খোঁজ নিলে তাকে চেনা যায় গায়ক হিসেবে। আর কর্পোরেট জগতে ১৬০ টাকার দারুণ এক প্যাকেজের কারণে খবরের শিরোনাম তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা। যাকে নিয়ে এত আলোচনা তিনি সাব্বির নাসির। পেশাগতভাবে পুরোদস্তুর একজন কর্পোরেট পারসন, আর মনেপ্রাণে একজন শিল্পী। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ‘স্বপ্ন’ সুপার শপের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় একযুগ। আর স্বপ্ন বিলিয়ে যাচ্ছেন সকল স্তরের ক্রেতা সাধারণের মাঝে। সেই স্বপ্নের কিছুটা আবার তিনি রেখে দিয়েছেন নিজের জন্য, শিল্পীসত্তার চাষবাষ করেন মনের গহীন কোণে।
‘হ্যালো বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে সাব্বির নাসিরের সাথে কথা হয় তার সাম্প্রতিক ‘স্বপ্ন’ময় গিমিক ও শিল্পী জীবন নিয়ে।
আলাপের শুরুতেই আসে গোটা দেশে সাড়া জাগানো ১৬০ টাকার অফার। কি সেই অফার? সাব্বির নাসিরের কক্ষজুড়েই ‘গরুর মাংস ও আলুর প্যাকেজের’ সেই অফারের ভিজ্যুয়াল চোখে পড়ে। এই প্যাকেজ নিয়ে সাব্বির নাসির বললেন, বিষয়টি শুধু ছোট প্যাকেজের নয়, বিষয়টি পুষ্টিরও।
তার মানে শুধু যে টাকা কমিয়ে সবার হাতের নাগালে আলু আর আমিষের সম্মিলন, সেটি মূল নয়? সাব্বির নাসির হেসে জানালেন, একদমই না। বরং ‘স্বপ্ন’ সুপার শপের গবেষণা বিভাগ ও তার নিজের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এ দেশের মানুষ আসলে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার না খাওয়াতে অনেক ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে এই দেশের মানুষ। তার মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি অবশ্যই একটি কারণ। তবে এর পেছনে বাঙালির দিলখোলা হাতও আছে।
সেটা কেমন? বাংলাদেশিরা অল্প বাজার করতে শেখেনি। আবার বিক্রেতাও অল্প বিক্রি করার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত নয়। ফলে দ্বিধাদ্বন্দ্বের রেসে হারিয়ে যায় পুষ্টি। সাব্বির নাসির মনে করেন, এই ধরনের প্যাকেজ অনেককে সেই দ্বিধা থেকে বের হতে সহায়তা করেছে। এটি শুধু ব্যাচেলর বা দম্পতির জন্য প্যাকেজ, তা নয়। বরং এই প্যাকেজ তাদের জন্য যাদের একবারে বেশি কেনার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ধীরে ধীরে এই সংস্কৃতিটা চালু হওয়া খুব দরকার। যার কম দরকার তিনি ২টা টমেটো কিনবেন, যার বেশি দরকার তিনি এক কেজি কিনবেন। যার কম প্রয়োজন তিনি ১০ টাকার মরিচ কিনবেন, যার বেশি লাগবে তিনি বেশি কিনবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবসময়ই হাত ভরে কিনতে হবে।
পুষ্টির কথা মাথায় রেখে সাব্বির নাসির জানালেন, আরও কিছু প্যাকেজ নিয়ে এসেছে ‘স্বপ্ন’। যেমন- চাল-ডাল-ডিমের খিচুড়ি প্যকেজ, বিভিন্ন সবজির প্যাকেজ, সালাদের আইটেম নিয়ে প্যাকেজ, ইত্যাদি। সালাদের প্যাকেজে থাকে একটি শশা, কাঁচা মরিচ, দুটি টমেটো, একটি পেঁয়াজসহ আরও টুকটাক ঋতুভিত্তিক সবজি। এমন নয় যে এই প্রথম ‘স্বপ্ন’ এমন উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক আগে থেকেই ফল ও কাটা সবজির প্যাকেজ পাওয়া যেত, যা ছোট পরিবার বা ব্যাচেলরদের জন্য বেশ উপকারী। তবে ১৬০ টাকায় মাংস ও আলুর প্যাকেজটি পুঁজিবাদী মনের ওপর বাউন্ডারির বাইরে এক ছক্কা।
এই ছক্কা শুধু পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নয়। আরও অনেকভাবে মানবিকতায় স্কোর করে গেছে ‘স্বপ্ন’। ২০১৯ সালে এক তরুণ তার সন্তানের জন্য দুধ চুরির অভিযোগে আটক হন ‘স্বপ্ন’ থেকে। এই খবর কানে পৌঁছাতেই সাব্বির নাসির ও তার টিম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। সাব্বির নাসির বলেন, বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর ও মর্মস্পর্শী যে আমি আসলে হতবাক হয়ে যাই। দুধ চুরি? সে তো এক অমানবিকতার ফল। এ কারণে একজন তরুণ জেল খাটবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
এরপর সাব্বির নাসির ওই তরুণকে ছাড়িয়ে আনেন। সন্তানের জন্য দুধ দেন এবং ছেলেটিকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
সাব্বির নাসির জানালেন, সেই তরুণ বাবা মোট সাড়ে চার বছর তাদের সাথে একই টিমে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। পরে অন্য প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়েছেন।
এছাড়া সম্প্রতি দুই নারী একই কারণে ‘স্বপ্ন’ শপের সিসিটিভিতে ধরা পড়লে তাদেরকেও দুধ ও একমাসের বাজার পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে তাকে অনেকেই বলেছেন, এটি তো বানোয়াট হতে পারে। তিনি প্রতিবারই বলেছেন যে তিনি খোঁজ নিয়েছেন। এরপর যদি অন্যকিছু থাকে, তাহলে আর কিছু বলার নেই। তবে বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার কাজ করে থাকেন বলে জানান।
এর পেছনে তার ভেতরের শিল্পীসত্তার প্রভাব আছে কিনা— এর উত্তরে তিনি হেসে জানান, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কারণেই অভিনয় শিল্পীসংঘের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশজন শিল্পীকে বাজার উপহার দেওয়ার চুক্তি করে ‘ম্বপ্ন’।
আবার নিজেও খোঁজখবর রাখেন সকল শাখার শিল্পীদের। গল্পের স্রোতেই কর্পোরেট সাব্বির চলে আসেন শিল্পী সাব্বিরের ভূমিকায়। যার যাত্রা ব্যান্ড থেকে। ছোটবেলায় ব্যান্ডে গিটার বাজানো সাব্বিরের কণ্ঠ শুনে মোহিত হন তার ব্যান্ডের সদস্যরা। শুরু করেন গান করা। ‘মেটামরফোসিস’ ছিল তার সেই কাঁচা বয়সের ব্যান্ডের নাম। পাশাপাশি লেখাপড়া তো ছিলই। পড়ার চাপ, প্রকৌশলী হওয়ার তাড়া, অন্যদিকে চাকরির গরম বাজার! সাব্বির নাসির কাজ শুরু করেন বিখ্যাত পদার্থবিদ ও গণিতবিদ জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা সহকারী হিসেবে। তারপর বাটা সু কোম্পানি, গলফরেট অ্যাঙ্গোলা, ডেকো গ্রুপ, টেট্রাপেক, অটবির পর যোগ দেন স্বপ্নে। মাঝে আইবিএ থেকে এমবিএসহ বিদেশে ডিগ্রি অর্জনেরও বিশাল এক অধ্যায় আছে তার।
সব মিলিয়ে গান আর শিল্প পিছিয়ে গেল রেসে। এর মাঝেই ব্যক্তিগত জীবনে চলে চড়াই উৎড়াই। তিনি নিজেকে বোঝার জন্য নানা রকম সেশনে অংশ নেন। তখন তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ছিলেন বিদেশে। সেখানেই সেই ১৪ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে ওঠা, আর ষোল বছর বয়স থেকে মঞ্চে পারফরম করা সাব্বির নাসিরের পুনর্জন্ম ঘটে। যে সুর তাকে ছেড়ে গিয়েছিল সেই সুরের মাঝেই আবার খুঁজে পেলেন নিজেকে। আর ছাড়াছাড়ি নয়, এবার লেখায় ও গানে ফিরলেন জোরেশোরে। হর্ষ শিরোনামের গান দিয়ে শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় চলে আসেন। অর্জন করেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। যার মাঝে আছে চ্যানেল আই ডিজিটাল অ্যাওয়ার্ড ও সিজেএফবি পুরস্কার। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী নিয়ে নির্মিত একটি ছবিতে কণ্ঠশিল্পী কোনালের সাথে প্লেব্যাক করেন তিনি। শিগগিরই এই শিল্পীর নতুন গান শুনতে পাবেন শ্রোতারা।
এভাবেই একদিকে ‘স্বপ্ন’র মাধ্যমে পুষ্টি নিয়ে যেমন ভাবেন, তেমনই কখনও কৃষকের ক্যাপসিকাম কিনে আনেন লট ভরে, কোনো অসহায় বাবার জন্য ব্যবস্থা করেন কর্মসংস্থানের। আবার কখনও মায়ের মুখে হাসি ফোটান সারা মাসের অন্ন যোগাড় করে। কখনও শিল্পীর পর্দার আড়ালের জীবনকে স্বস্তির করে তোলেন, কখনও নব্বইয়ের দশকের গানে ‘স্বপ্ন’ আউটলেটে বাজার করতে আসা ক্রেতার মন ছুঁয়ে দেন।
এভাবেই সব্যসাচী সাব্বির নাসিরের মনে ও মেধায় সবসময় তাগিদ থাকে কিছু করার। আর তা শুধু মানুষের জন্য।