Home মুখোমুখি শেয়ারবাজারের জন্য বাজেটে থাকছে একগুচ্ছ প্রণোদনা

শেয়ারবাজারের জন্য বাজেটে থাকছে একগুচ্ছ প্রণোদনা

ইকবাল হোসেন
৫৯ views

অধ্যাপক আবু আহমেদ দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ। দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একক ব্যক্তি হিসেবে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে হ্যালো বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনিসাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন।  

ভিন্ন বাস্তবতায় এবারের বাজেট। রাজনৈতিক সরকার নেই। বাজেট ঘোষণা হচ্ছে সংসদের বাইরে। রাষ্ট্র সংস্কার আলোচনা চলছে। সবকিছু মিলে পুরো পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অর্থনীতি যে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটা ৫ আগস্টের আগে অনেকে বুঝতে পারেনি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই অর্থনীতিতে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে তা সবার কাছে এখন পরিষ্কার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ পরিস্থিতিসহ যেসব সূচক আগে দেখানো হতো খুব ভালো। সেগুলো বাস্তবিক অর্থে যে অবস্থায় ছিল, তা দেখানো হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে সবকিছুর বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক সরকার নেই। বাস্তবভিত্তিক একটা বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে বড় আকারের বাজেট হলে উন্নয়ন বাজেটে আরো কিছু প্রকল্প নেওয়া যেতো। এটি করের বোঝা আরো বাড়াতো। অথবা ঘাটতি বাজেট আরো বিশাল আকার ধারণ করতো। সরকার যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করছে, এটা অতীতের ঘাটতি পূরণের জন্য। কারণ সুদ তো দিতেই হচ্ছে। এজন্য বর্তমান সরকার একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে- বিশাল আকারের বাজেট নিয়ে তারা ঘাটতি আর বাড়াতে চায় না। আয়ের চেয়ে ব্যয় যত বাড়ানো হবে, ততই ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। বাংলাদেশে এখন যে ঋণের বোঝা, তার বেশিরভাগই অভ্যন্তরীন উৎস থেকে। এটা গত ১৫ বছর হয়ে এসেছে। এ সরকার খুব বেশি ঋণ করছে না।

আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এটা মন্দ না। আমরা এটি অর্জন করতে পারলে অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। পরের বছর আরো বাড়বে। কারণ প্রধান সূচকগুলো আমাদের অনুকূলে আসছে। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আছে, মূল্যস্ফীতি কমছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, ডলারের সংকট কেটেছে, রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে- এটা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় স্বস্তির। আগে সরকারের অনেক বড় বড় দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। সবকিছু মিলে এখন একটা আস্থার পরিবেশ ফিরে এসেছে। 

এবারের বাজেটে সুনির্দিষ্ট কী কী চ্যালেঞ্জ থাকছে?
এবারের বাজেটে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো। অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়ার কারণে কর সংগ্রহ কম হয়েছে। চাইলেই ট্যাক্স কালেকশন রাতারাতি বাড়ানো যাচ্ছে না। ট্যাক্স রেট না বাড়িয়ে আয়করের আওতা বাড়ানো উচিত। মাঝারি ও অন্যান্য ব্যবসায়ী, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বড় ব্যবসায়ীদের করজালের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। ট্যাক্স রেট বাড়ালে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে (কোম্পানিসহ) তাদের উপর জুলুম করা হয়। আমাদের ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এটি কতটা সঠিক হয়েছে বলে মনে করেন?
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে অপব্যয় হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোতে যথাযথভাবে কাজ না করে টাকা হাতিয়া নেওয়া হচ্ছে। অর্থ অপচয় হচ্ছে। শিক্ষাতে একই অবস্থা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। দক্ষ সরকার না হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। দক্ষ সরকার মানে স্টাফ, কর্মকর্তা বেশি হবে-এমনটা না। এমনটা প্রয়োজন নেই। আমাদের চেয়ে বড় অর্থনীতের দেশেও সরকারের সাইজ অনেক ছোট।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে করদাতাদের টাকা যোগ হচ্ছে। এসব খাতে প্রশ্ন উঠার যথেষ্ট কারণ আছে। কিভাবে স্বাস্থ্য খাতকে দক্ষ করা যায় সে বিষয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা চলছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি, কিন্তু অনেক টাকা অপচয় হচ্ছে। দুর্নীতিতে সব খেয়ে ফেলছে। শিক্ষাতেও একই অবস্থা। শিক্ষক আছে, বেতন নিচ্ছে কিন্তু ক্লাসে যাচ্ছে না।  

aa2

অধ্যাপক আবু আহমেদ, ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

রাজস্ব আদায় বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
যে খাতগুলো করজালের আওতায় আসেনি, সেগুলোতে জোর দিতে হবে। জেলা-উপজেলা ও মফস্বল পর্যায়ে করের নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে পাশাপাশি অটোমেশনে যেতে হবে। ঢাকাতে এক একজন কয়েকটা বাড়ির মালিক কিন্তু তিনি ট্যাক্স দেন না।  এ রকম অনেকে আছেন। কোম্পানি লভ্যাংশ দেয় না, কিন্তু এমডির পাজেরো গাড়ি আছে। এগুলো এনবিআর ও বিএসইসির দেখা উচিত। কিছু পরিবর্তন আসবে। রাতারাতি বেশি পরিবর্তন আশা করা যায় না। অর্থনীতিতে যদি সাড়ে ৫ বা ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, তবে রাজস্ব আয় এমনিতেই বাড়বে। তখন বাজেটের আকারও বাড়বে।   

বাজেটে ব্যয় ও ঘাটতি মোকাবিলায় আপনার পরামর্শ কী?
ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। সরকারের আকার যদি ছোট করা যায়, সেটা সবচেয়ে বড় কাজ হবে। আমাদের দেশে একটা কালচার দাঁড়িয়েছে সরকারের সাইজ ছোট করা যাবে না। মিডিয়াগুলো  নিউজ করে এতগুলো পোস্ট খালি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পোস্ট অনুযায়ী কাজ নেই, বেতন দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের এতগুলো শিল্প-কারখানা যেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ আছে, ১৫ বছর আগে চালু ছিল। এগুলো আমরা রেখেছি কেন, সেটাই আমার প্রশ্ন। বিমান- এয়ার ইন্ডিয়া, পিআই বিক্রি করে দিয়েছে, আমরা রেখেছি কেন? অবশ্য বর্তমান সরকার নির্দেশনা দিয়েছে বিভিন্ন সংস্থাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।

অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বছর বছর ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। কৃষকের জন্য সার, সেখানে ভর্তুকি দরকার আছে।  কিন্তু কেন আমি একটা লোকসানি শিল্প-কারখানাকে, যেটা আর হবে না- সেটাকে সরকারের হাতে রেখে দিয়েছি। আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বছর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি।

এখন থেকে ২০ বছর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ক্যাবলস বেশ ভালো অবস্থানে ছিল, লাভ করতো। ওই সময় প্রতিযোগিতা ছিলো না। এখন প্রতিযোগিতার বাজারে এসে কোম্পানিটি কোন লাভ করে না। একই অবস্থা ন্যাশনাল টিউবস ও ওসমানী গ্লাস সিটের। আমরা এ প্রতিষ্ঠানগুলো রেখেছি কেন? এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত গণহারে ভর্তুকি কালচার থেকে আমরা বের হতে পারবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারের ব্যয় কমানো যাবে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তুকি দরকার হবে। যেটা প্রয়োজন নেই, সেটা আমরা ধরে নিয়ে বসেই আছি। এ কারণে আমরা যে ট্যাক্স সংগ্রহ করি, কিন্তু বেশি অপব্যয় হচ্ছে।  

সরকার ইতোমধ্যে এনবিআর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
সরকারের এনবিআর সংস্কারের সিদ্ধান্ত সঠিক। এটা আগের সরকারের সময় থেকে আমরা শুনছিলাম। নীতি ও রাজস্ব সংগ্রহ দুটি বিভাগ আলাদা হওয়া উচিত। বিশ্বের অনেক দেশে এটি আছে। আমাদের কর্মকর্তারা এটার বিরোধিতা করছে, তারা দেখাক অন্য দেশে এটা নেই, শুধু বাংলাদেশে করা হয়েছে। এটা উন্নয়ন সহযোগীদের পরার্মশে করা হয়েছে। আমাদের আরো আগে এটা করা উচিত ছিল।  

দেশ থেকে বেপরোয়াভাবে অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার বন্ধ ও অর্থ উদ্ধারে করণীয় কী?
সবার চোখে সামনে অর্থ পাচার হয়েছে, কিন্তু কেউ এটি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। গত সরকারের কারণে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ পাচার হয়েছে। কখন মানুষ অর্থ পাচার করে? যদি সহজে মানুষের কাছে অর্থ চলে যায়। ঋণ খেলাপিদের মাধ্যমে এ অর্থ গেছে। গত সরকারের সময় কতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ তারা নিজস্ব লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবার ভুয়া কোম্পানি তৈরি করে সেগুলোর নামে ঋণ নিয়ে সে টাকা পাচার করেছে। অনেকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় অর্থপাচার করেছে। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে, আবার হুন্ডির মাধ্যমেও অনেক টাকা পাচার হয়েছে। ৫ আগস্টের পর তা অনেক কমেছে।

বিদেশে টাকা একবার পাচার হলে তা উদ্ধার করা অনেক কঠিন। ওই সব দেশ সহজে সহযোগিতা করে না। পাচারের টাকায় সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির উপকার হয়। টাকা উদ্ধারের উদাহরণ খুব কম আছে, পাচারের দৃষ্টান্ত হাজার হাজার। আমাদের বিচার বিভাগ যদি ঠিক মত চলে, নির্বাচনের মাধ্যমে একটা দক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকে, যারা জনগণের কাছে স্বচ্ছ থাকবে (বিশেষ করে নেতৃত্ব), তাহলে কিছু পরিবর্তন আসবে।   

শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো নয়। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আসন্ন বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য একগুচ্ছ প্রণোদনা থাকবে। এ প্রণোদনা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে দেওয়া হবে না। অর্থনীতি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থে এটি দেওয়া হবে। বিশ্বের অনেক দেশে পুঁজিবাজার হচ্ছে অর্থের বড় উৎস। আমাদের দেশে উচ্চ মধ্যবিত্তকে শেয়ারবাজারে যুক্ত করতে পারলে শিল্প খাতে অর্থের কোন অভাব হবে না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কর্পোরেট কর ১০ শতাংশ কম এবং না হলে ১০ শতাংশ বেশি দিতে হবে। ভালো ডিভিডেন্ট দিলে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহ প্রদানের জন্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স রিবেট দেওয়া হতো। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হতো।

প্রথমবারের মতো কোন সরকার প্রধান শেয়ারবাজার নিয়ে সভা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফিরেয়ে আনার জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য একটা বিশেষ কমিটি করা হয়েছে। এটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।

বর্তমান সরকার সিরিয়াসলি শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলোকে এড্রেস করছে। গত ১৫ বছর বাজার তদারককারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যোগসাজশে একটা মাফিয়া গ্রুপ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। টাকা-পয়সা লুটপাট করে পাচার করেছে। ওই ধারা এখন নেই। চাকচিক্যময় বাজার উঠছে, সূচক বাড়ছে- এমন অবস্থা এখন না থাকলেও যে পরিবর্তন আসবে তা হবে সত্যিকারের পরিবর্তন। যদি সংস্কারগুলো যথাযথভাবে করা হয়। 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ