Home স্বাস্থ্য ডোপ টেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ডোপ টেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

তাসনিম তাবাসসুম
১১১ views

ডোপ টেস্ট একটি মেডিকেল পরীক্ষা, যার মাধ্যমে শরীরে মাদক বা নেশা জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। এটি সাধারণত ক্রীড়া, সরকারি বা বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রমে মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়।

ডোপ টেস্ট কী?
নিয়মিত মাদক বা অ্যালকোহল গ্রহণ করলে শরীরে ওই নেশাজাতীয় পদার্থের কিছুটা হলেও থেকে যায়। আর সেটিই ডোপ টেস্টের মাধ্যমে ধরা পড়ে। কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্ত কি না তা যাচাইয়ের জন্য যে পরীক্ষা করা হয় তাই ডোপ টেস্ট।

এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির মূত্র বা রক্ত, আবার কখনো দুটির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। মাদক গ্রহণ করা ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শেষ ১ সপ্তাহে মুখের লালার মাধ্যমে, শেষ ২ মাস রক্তের মাধ্যমে, শেষ ১২ মাস বা ১ বছরে চুল পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া যায় মাদকের নমুনা।
কাদের ডোপ টেস্ট করানো হয়?
ডোপ টেস্ট সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বা প্রয়োজন অনুযায়ী করানো হয়, যেমন:

ক্রীড়াবিদদের জন্য
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অ্যাথলেটদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক। অলিম্পিক, ফুটবল, ক্রিকেট, ভারোত্তোলনসহ বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টে প্রতিযোগীদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়।

সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে ডোপ টেস্টের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে। সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চালক ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের জন্য
বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত যানবাহন চালকদের লাইসেন্স প্রদান ও রিনিউয়ের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হয় যাতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। বিমানচালক ও নৌযানের ক্যাপ্টেনদেরও এই পরীক্ষা করতে হয়।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছুদের জন্য
উন্নত অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশেষ কোর্সে ভর্তি হওয়ার সময় ডোপ টেস্ট করানো হয়। বাংলাদেশেও কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মাদকমুক্ত থাকার নিশ্চয়তা দিতে ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করার হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কর্তৃপক্ষ ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য নবীন শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট চালু করার পরিকল্পনা করেছে।

কারাবন্দি ও সন্দেহভাজন অপরাধীদের জন্য
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করে থাকে। বিশেষ করে মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের এই পরীক্ষার আওতায় আনা হয়।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
নির্মাণকর্মী, খনি শ্রমিক, চিকিৎসক, ও অন্যান্য সংবেদনশীল কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ডোপ টেস্ট করানো হয়, যাতে কর্মক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি না থাকে।

বিদেশে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি নাগরিক
বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক। এটি মাদকাসক্তি মুক্ত নিশ্চিত করতে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণের জন্য প্রয়োজনীয়। সাধারণত, বিদেশগামী কর্মীদের স্ব-স্ব দেশের দূতাবাস কর্তৃক নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়, যেখানে ডোপ টেস্ট অন্তর্ভুক্ত থাকে।
এছাড়াও, শিক্ষা, গবেষণা বা কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে চাইলে বাংলাদেশি নাগরিকদের মাদক পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দিতে হয়।

ডোপ টেস্টার প্রক্রিয়া
ইউরিন বা মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ডোপ টেস্ট করা হয়। কোনো মাদক সেবনের পর মুখের লালা বা থুথু পরীক্ষা করে শনাক্ত করা যায় তার উপস্থিতি। যেমন- গাজা সেবন করার পরবর্তী ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত মুখের লালা থেকে এই মাদক পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায় মুখের লালা পরীক্ষা মাধ্যমে।

শরীরে মাদকের কোনো উপস্থিতি আছে কি না তা পরীক্ষার অন্যতম এক উপায় হলো রক্ত পরীক্ষা। আপনার শরীরে রক্ত টেস্টের মাধ্যমে মাদকের উপস্থিতির সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়।

ডোপ টেস্টের ক্ষেত্রে চুল পরীক্ষা করার মাধ্যমেও মাদক শনাক্ত করা হয়। যে কোনো মাদক গ্রহণের পরবর্তী ৯০ দিন পরেও চুল পরীক্ষার মাধ্যমে তা ধরা পড়ে সহজেই।

মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে মাদকের উপস্থিতি সহজে শনাক্ত করা যায়। রক্ত পরীক্ষায় মাদকের সুনির্দিষ্ট মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব। লালা পরীক্ষায় সাম্প্রতিক মাদক সেবনের তথ্য পাওয়া যায়, এবং চুল পরীক্ষায় মাদক সেবনের দীর্ঘমেয়াদি ইতিহাস জানা যায়।

ট্রাফিক পুলিশরা সন্দেহজন চালকদের নিঃশ্বাস পরীক্ষার মাধ্যমে মাদক শনাক্ত করেন। অ্যালকোহল ডিটেক্টরের মাধ্যমে এই টেস্ট করা হয়।

কোথায় করা হয় ও কত খরচ?
সারাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে ডোপ টেস্ট করানো যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ডোপ টেস্টের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ ফি ৯০০ টাকা। নন-স্পেসিফিক পরীক্ষা যেমন- বেঞ্জোডায়াজেপিন, এমফেটামাইনস, অপিয়েটস ও কেননাবিনেয়েডস- এই চারটির প্রতিটির ফি ১৫০ টাকা এবং অ্যালকোহল পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত ডোপ টেস্টে মহানগরীর হাসপাতালগুলো হলো, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।

এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কিছু স্থানে ডোপ টেস্ট শনাক্তকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে- রংপুর, ঢাকা, চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, পাবনা, সিলেট, খুলনা, বগুড়া, গাজীপুর, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, যশোর, নরসিংদী ও টাঙ্গাইল। এই জেলাগুলোতে ডোপ টেস্টের জন্য মিনিল্যাব বসানো হয়েছে।

ডোপ টেস্ট করার নিয়ম
কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে ডোপ টেস্ট করা হয়। প্রথমে যে ব্যক্তির ডোপ টেস্ট করানো হবে তার পরিচয় জমা নেওয়ার জন্য একটি ফরম পূরণ করতে হবে। সেখানে তার নাম, ঠিকানা, বয়স, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদির তথ্য দেওয়া থাকবে।

ডোপ টেস্টের ফরম পূরণ করার পর নমুনা জমা দিতে হবে। একজন বিসিএস ক্যাডার ডাক্তার দিয়ে ওই নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনাতে যে কোনো মাদক ধরা পড়লে ডোপ টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসবে। আর ওই ব্যক্তি যদি মাদকাসক্ত না হন তাহলে তার নমুনা পরীক্ষায় ডোপ টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে।
ডোপ টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদক শনাক্ত করা সম্ভব, যেমন:
ডায়াজেপাম, লোরাজেপাম, অক্সাজেপাম, টেমাজেপাম, কোডিন, মরফিন, হেরোইন, কোকেন, গাঁজা, ভাং, চরস, অ্যালকোহল,ফেনসিডিল, ইয়াবা, এলএসডি।

বাংলাদেশে ডোপ টেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ ?
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির সমস্যা ক্রমবর্ধমান। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে মাদক নিয়ন্ত্রণে ডোপ টেস্টের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। সরকারি চাকরিতে প্রবেশ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন এবং অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডোপ টেস্ট শুধুমাত্র মাদকাসক্তি শনাক্তের একটি উপায় নয়, এটি একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাদকাসক্তি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ক্রীড়াঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আল জাজিরা 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ