Home ফিচার মে দিবস: ইতিহাস, গুরুত্ব ও আধুনিক শ্রম আন্দোলনের ভিত্তি

মে দিবস: ইতিহাস, গুরুত্ব ও আধুনিক শ্রম আন্দোলনের ভিত্তি

৬৫ views

প্রতিবছর পহেলা মে আমাদের সামনে হাজির হয় একটি দিন, যা শুধু একটি দিন নয়— ইতিহাস, একটি আন্দোলনের চেতনা ও সংগ্রামের প্রতীক। মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামে পরিচিত এই দিনটি, পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক গৌরবময় ইতিহাস বহন করে। দিনটি মনে করিয়ে দেয়—সমাজের অগ্রগতির পেছনে যাঁরা দিনরাত শ্রম দেন, তাঁদের রক্ত, ঘাম ও সংগ্রামের ফলেই গড়ে ওঠে সভ্যতা।

শ্রমিকদের ভবিষ্যতের জন্য আত্মত্যাগ, ঐক্য এবং সংগ্রামের দিন মি দিবস। ১৮৮৬ সালের শিকাগোর ‘হে মার্কেট’ আন্দোলন থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক শ্রমনীতি পর্যন্ত, মে দিবস শ্রমিক অধিকারের স্বীকৃতির এক দীপ্ত আলো। আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সঠিক মজুরি—এসব শ্রমজীবী মানুষের কঠিন লড়াইয়ের অর্জন।প্রতিবছর ১লা মে বিশ্বের বহু দেশে এই দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। 

মে দিবসের ইতিহাস

মে দিবসের সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের ১ মে, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক ‘আট ঘণ্টা শ্রম’ দাবিতে ধর্মঘটে নামে। সেই সময় শ্রমিকদেরকে দৈনিক ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো, কোনো ছুটি বা শ্রমিক অধিকার ছিল না বললেই চলে। মে মাসের এক তারিখ এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব ঘোষিত সাধারণ ধর্মঘটে আমেরিকার বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের স্লোগান ছিল,

‘Eight Hours for work. Eight hours for rest. Eight hours for what we will.’

3 may day

১ মে হাজার হাজার শ্রমিক ‘আট ঘণ্টা শ্রম’ দাবিতে ধর্মঘটে নামে, ছবি: হিস্ট্রি চ্যানেল

ধর্মঘট চলাকালে ৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে এক সমাবেশে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বোমা বিস্ফোরণে পুলিশের মৃত্যু ঘটে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে অনেক শ্রমিক হতাহত হন।

এই সংঘর্ষে সাতজন পুলিশ এবং চারজন  শ্রমিক নিহত হয়। দাবি আদায় করতে আসা শত শত নিরস্ত্র শ্রমিক হতাহত হয়। পৃথিবীর শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে এটি লেখা হয়ে থাকে ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে।

এই ঘটনার পর আটজন শ্রমিক নেতাকে অন্যায্যভাবে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী ছিলেন। এদেরকে ‘শিকাগোর শহীদ’ হিসেবে স্মরণ করা হয়। ঘটনার স্মরণে ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মে দিবস আজ শুধু শ্রমিক অধিকার আদায়ের দিন নয়, এটি মানুষের ন্যায্য মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের দাবি জানানোর প্রতীক। এই দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। আজকের যেসব শ্রমিক অধিকার,যেমন আট ঘণ্টার কর্মদিবস, সাপ্তাহিক ছুটি, শ্রমিক কল্যাণ সুবিধা তা সহজে আসেনি, বরং কঠিন সংগ্রামের ফল।

শ্রম আইন ও মে দিবস

মে দিবসের আন্দোলনই বিশ্বব্যাপী শ্রম আইনের উন্নয়নের সূচনা করে। ২০শ শতকে বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা, ন্যূনতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয়কে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

কর্মঘণ্টার বাইরেও, মে দিবসের নীতিগুলো কর্মসংস্থানের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রম আইনের একটি বিস্তৃত কাঠামো উন্নয়নে অবদান রেখেছে।

ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি, শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, শ্রমিকদের জন্য একটি মৌলিক জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার জন্য ন্যূনতম মজুরি আইন প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করেছে।

2 mmay day

পৃথিবীর শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে এটি লেখা হয়ে থাকে ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে, ছবি: কোলাজ মেকার

বিপজ্জনক কর্মপরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই, যা প্রায়শই মে দিবসের বিক্ষোভকালে তুলে ধরা হয়, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিধিবিধান বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত করেছে।

শ্রমিকদের সংহতির নীতি, মে দিবসের একটি ভিত্তি, এমন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের এবং মজুরি ও কর্মপরিবেশ নিয়ে দর কষাকষি করার অধিকার রক্ষা করে।

সামাজিক ন্যায়বিচারের বৃহত্তর সাধনা, যা শ্রমিক আন্দোলনের লক্ষ্যের সাথে জড়িত, জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম এবং অক্ষমতার মতো কারণের ভিত্তিতে কর্মসংস্থানে বৈষম্য নিষিদ্ধকারী আইন প্রণয়নে অবদান রেখেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) ১৯১৯ সালে গঠিত হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ। মে দিবসের আদর্শ আজও নতুন শ্রম আইন প্রণয়নে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশেও মে দিবসের প্রভাবে শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন (বাংলাদেশ  লেবার এক্ট ২০০৬) গৃহীত হয়, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার, বেতন, নিরাপত্তা ও সংগঠনের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

নবজাগরণ থেকে আধুনিকতায় শ্রমজীবীদের বিবর্তন

ইউরোপের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ যুগে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারের ধারণা জন্ম নেয়। যদিও সেই সময় কৃষি ও সামন্তবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না, ধীরে ধীরে শিল্পবিপ্লবের পর শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। ১৮-১৯ শতকে যখন কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে, তখনই প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি হয়। নবজাগরণের চিন্তা ও মানবাধিকারের ধারণা শ্রমচেতনার ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়।

mm last

আজকের শ্রমজীবী সমাজ আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, তবুও মৌলিক অধিকার রক্ষা, ন্যায্য মজুরি এবং কাজের নিরাপত্তা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ, ছবি: ফ্রিপিক

মে দিবস এই বিবর্তনের একটি ফলাফল। এটি রেনেসাঁ-উত্তর মানবিক চেতনা ও শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী শ্রমিক সংগ্রামের সমন্বয়। আধুনিক যুগে, ডিজিটাল ও গ্লোবাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে শ্রমিকের সংজ্ঞা ও অধিকার বদলাচ্ছে, কিন্তু মে দিবস এখনও মৌলিক ন্যায় ও সম্মানের কথা বলে।

বর্তমানে মে দিবস শুধুমাত্র কারখানার শ্রমিকদের জন্য নয় — গৃহকর্মী, প্রযুক্তি খাতের কর্মী, ফ্রিল্যান্সার, কৃষক — সকল উৎপাদক মানুষের সংগ্রামের অংশ। কোভিড-১৯ মহামারির সময় স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবহন শ্রমিকদের যে ভূমিকা আমরা দেখেছি, তা মে দিবসের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। আজকের শ্রমজীবী সমাজ আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, তবুও মৌলিক অধিকার রক্ষা, ন্যায্য মজুরি এবং কাজের নিরাপত্তা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।

মে দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক স্মারক নয়, এটি একটি চেতনা যা মানবাধিকার, মর্যাদা ও সামাজিক সাম্যের কথা বলে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকরা সমাজের চালিকাশক্তি, এবং তাদের প্রতি সুবিচার প্রতিষ্ঠা একটি নৈতিক দায়িত্ব। এই দিনটি শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য, সংগ্রাম এবং বিজয়ের প্রতীক।

সূত্র: আইএলও, ব্রিটানিকা ও হিস্ট্রি চ্যানেল 

 

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ