আজ বিশ্ব বাবল টি দিবস। তাইওয়ানের এই পানীয় এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। তাইওয়ান শহরের রাস্তাগুলোয় রাতে বের হলে দেখতে পাবেন এখানকার আলোয় ঝলমলে রাস্তাগুলো যেন উৎসবের মেলা। শত শত মানুষ সেখানে হাঁটছে ধীরে ধীরে, থেমে থেমে, রাস্তার পাশে স্ট্রিট ফুডের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে। সেই সব খাবারের ভিড়েও যে দোকানগুলো সব সময় সবার নজর কাড়ে, তা হলো বাবল টি বা বোবা টি বিক্রির স্টল।
বাজারের ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে পড়া ক্রেতা হোক বা সারাদিন দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারি—দিনের শেষে এক কাপ বাবল টি যেন তাদের প্রাণ ফেরানোর প্রিয় উপায়। শুধু পানীয় নয়, বাবল টি তাইওয়ান শহরজুড়ে এক কোমল আশ্রয়, স্বস্তির নাম।
‘বাবল টি’ বা ‘বোবা টি’ কিন্তু একেবারেই আধুনিক এক সৃষ্টি। এই নতুনত্বের মাঝেই আছে এক মজার ইতিহাস, যা এক ব্যর্থতা থেকে জন্ম নিয়েছিল।

বাবল টি দেখতে যেমন দৃষ্টিনন্দন, খেতেও তেমনই চমকপ্রদ, ছবি: স্পটন
ঘটনার শুরু হয় ১৯৮৬ সালে, তাইওয়ানের একজন শিল্পী ও উদ্যোক্তা টু সং-এর হাত ধরে। চায়ের প্রতি তাইওয়ানের গভীর ভালোবাসা ও চা শিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নামেন। তার পরিকল্পনা ছিল নতুন কিছু করার, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সব কিছুই উল্টো পথে চলতে থাকে। একের পর এক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হয় তার। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লক্ষ তাইওয়ানিজ ডলার লোকসানে পড়েন।
তবে টু সং হাল ছাড়েননি। তিনি বুঝতে পারলেন, সাধারণ চা দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করা যাচ্ছে না—চাহিদা আছে এমন কিছুর, যা চেনা স্বাদের বাইরে, একটু নতুন, একটু মজার। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় এক অভিনব ধারণা—দুধ চায়ের সঙ্গে ট্যাপিওকা দানা ও বরফের টুকরো মিশিয়ে তৈরি এক ভিন্নধর্মী পানীয়। দেখতে যেমন দৃষ্টিনন্দন, খেতেও তেমনই চমকপ্রদ।
তবে শুরুতে এর উপস্থাপনায় ছিল কিছু সমস্যাও। সে সময় এমন কোনো স্ট্র পাওয়া যেত না, যার মাধ্যমে চা পান করতে গিয়ে মুখে ঢুকবে ট্যাপিওকা বল কিংবা বরফের টুকরো। ফলে অনেকেই প্লাস্টিক চামচ দিয়ে বলগুলো তুলে খেতেন, যা ছিল কিছুটা বিরক্তিকর ও অস্বস্তিকর। এই সমস্যা সমাধানে টু সং নিজেই উদ্যোগ নেন—স্ট্র তৈরি করা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তৈরি করান মোটা ও প্রশস্ত স্ট্র, যার মাধ্যমে তরল, বরফ ও ট্যাপিওকা একসাথে মুখে পৌঁছাতে পারে।

ট্যাপিওকা পার্ল বাবল টি-এর মূল উপকরণ, ছবি: শাটার স্টক
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাইওয়ানের বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠতে থাকে অসংখ্য বাবল টি শপ। প্রথমে শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো এই নতুন পানীয়কে মেনুতে যুক্ত করে। এটি ধীরে ধীরে রাস্তাঘাটের সাধারণ স্ট্রিট ফুড দোকানগুলোতেও প্রবেশ করে, এবং ব্যাপক জনস্বীকৃতি পেতে শুরু করে। বাবল টি হয়ে ওঠে তাইওয়ানের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৯০-এর দশকে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে চোখ ফেরায়। নিজেদের পণ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই সাথেই অনেক তাইওয়ানিজ নাগরিক পাড়ি জমান বিদেশে—ব্যবসা, শিক্ষা কিংবা জীবিকার খোঁজে। আর তাদের সাথেই বাবল টি পাড়ি জমায় সীমান্ত পেরিয়ে নতুন নতুন দেশে।
এইভাবেই বাবল টি পৌঁছে যায় আমেরিকায়, যেখানে ১৯৯০ সালের দিকেই বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠতে শুরু করে বাবল টি শপ। তরুণ প্রজন্মের মাঝে এটি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর ৩০ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক বাবল টি দিবস, যা জনপ্রিয় ‘বাবল টি’ প্রেমীদের জন্য একটি বিশেষ দিন। এই দিবসটি বোবা টি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও জনপ্রিয়তাকে উদযাপন করে।
বাংলাদেশেও বাবল টি-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে অসংখ্য বোবা টি ক্যাফে ও দোকান গড়ে উঠেছে। শুধু চা এর সাথে না বিভিন্ন ফ্লেভারের পানীয়র সাথে ব্যবহার করা হয় ট্যাপিওকা পার্ল বা ‘বোবা’। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই বাবল টি ও ড্রিংক একটি ফ্যাশনেবল ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড টি নিউজ ও স্পটওন