আজ ২৯ এপ্রিল আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস (International Dance Day )। প্রতি বছর এই দিন আধুনিক ব্যালে নৃত্যের জনক জঁ-জর্জ নোভের (Jean-Georges Noverre, ১৭২৭–১৮১০) জন্মদিনকে স্মরণ করে এই দিবসটি উদযাপিত হয়। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কোর সহযোগী সংস্থা International Theatre Institute (ITI) এই দিবসের প্রবর্তন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী নৃত্যশিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং নৃত্যকে একটি সার্বজনীন শিল্পরূপ হিসেবে উদযাপন করা। বিশ্ব নৃত্য দিবসের মূল লক্ষ্য হলো নৃত্যকে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা, যা জাতি, সংস্কৃতি ও ভাষার সীমা অতিক্রম করে মানুষকে একত্রিত করতে পারে।
এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নৃত্য পরিবেশনা, কর্মশালা, সেমিনার ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে নৃত্যশিল্পের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য উদযাপন করা হয়। প্রতি বছর একজন খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী বা কোরিওগ্রাফার এই দিবস উপলক্ষে একটি বার্তা প্রদান করেন, যা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এ বছর লাটভিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্যালে নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ও হলিউড অভিনেতা মিখাইল ব্যারিশনিকভকে এই বার্তার জন্য নির্বাচিত লেখক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ও হলিউড অভিনেতা মিখাইল ব্যারিশনিকভ, ছবি: ফোর্বস
নাচ কখনো আনন্দের, কখনো প্রতিবাদের, কখনো বা ঈশ্বরের আরাধনার রূপ। বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে নিজস্ব ছন্দ ও শরীরী ভাষার এক অনন্য ইতিহাস। চলুন ঘুরে আসি নানা দেশের নাচের এক মোহময় ভুবন থেকে-
ভারতের ভরতনাট্যম: দেবতার আরাধনায় তালবদ্ধ শরীর
ভারতের দক্ষিণে জন্ম নেয়া ভরতনাট্যম, বিশ্বের প্রাচীনতম শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীদের একটি। মন্দিরের চত্বরে দেব-দেবীর বন্দনার জন্য শুরু হলেও, এখন এটি বিশ্বমঞ্চে মর্যাদাপূর্ণ নাচ। এর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, মুদ্রা আর আবৃত্তি মিলিয়ে এক শিল্পের পূর্ণতা তৈরি করে।

মন্দিরের চত্বরে দেব-দেবীর বন্দনার জন্য শুরু হয় ভরতনাট্যম, ছবি: দ্যা হিন্দু
স্পেনের ফ্লামেঙ্কো: আবেগের আগুনে জ্বলতে থাকা ছন্দ
স্পেনের আন্দালুসিয়ার মাটিতে জন্ম নেওয়া ফ্লামেঙ্কো নাচ রাগ, ভালোবাসা আর বেদনার এক কাব্য। জিপসি জনগোষ্ঠীর প্রভাবে গড়ে ওঠা এই নাচে গিটারের ঝংকার, হাততালি আর তালের প্রতিটি ঝড় তুলে দেয় আবেগের ঝরনা।

ফ্লামেঙ্কো নাচ রাগ, ভালোবাসা আর বেদনার এক কাব্য, ছবি: মুযেও দেল বাইলে ফ্লামেঙ্কো
ব্রাজিলের সাম্বা: জীবনের রঙিন উৎসব
ব্রাজিল মানেই সাম্বা! কার্নিভালের প্রাণ এই নাচ উৎসবের, মুক্তির আর গতি-বেগের প্রতীক। আফ্রিকান দাসদের ছন্দ আর ব্রাজিলিয়ান আবহাওয়া মিলে গড়ে তুলেছে এই রঙিন, প্রাণবন্ত নৃত্যশৈলী।

কার্নিভালের প্রাণ সাম্বা উৎসবের, মুক্তির আর গতি-বেগের প্রতীক, ছবি: ভোয়ে গ্লোবাল
জাপানের নোহ ও কাবুকি: মঞ্চনাটকের ছায়ায় ধীর নৃত্য
জাপানের নোহ (Noh) ও কাবুকি (Kabuki) নৃত্য-নাট্যের এক অভিনব মিশ্রণ। সুরেলা সঙ্গীত, মুখোশ আর ধীর, অভিব্যক্তিপূর্ণ গতিতে এগোয় এই নাচ। জাপানি সংস্কৃতির মিতভাষী সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি এগুলো।

জাপানের নোহ (Noh) ও কাবুকি (Kabuki) নৃত্য-নাট্যের এক অভিনব মিশ্রণ, ছবি: মিডিয়াম
আফ্রিকার আদিবাসী নাচ: প্রাকৃতিক শক্তির উদযাপন
আফ্রিকার অসংখ্য গোত্রের নিজস্ব নাচ আছে, যেখানে প্রাকৃতিক শক্তি, যুদ্ধ, ফসল কাটার আনন্দ বা আত্মার শক্তির আরাধনা ফুটে ওঠে। ঢাকের তালে, পদচারণার কম্পনে এবং শরীরের মুক্ত গতিতে সেখানে জীবন স্পন্দিত হয়।

আফ্রিকার নাচ মানেই পদচারণার কম্পন এবং শরীরের মুক্ত গতিতে জীবনের স্পন্দন, ছবি: মোমা
আয়ারল্যান্ডের রিভারডান্স: তপ্ত মাটির ঠকঠকানো ছন্দ
আয়ারল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী রিভারডান্স বা আইরিশ নাচ মূলত দ্রুতগতির পদচারণা আর কোমরের স্থিরতায় বিখ্যাত। ১৯৯০-এর দশকে এই নাচ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায়, আর আজও বিশ্বমঞ্চে আইরিশ পরিচয়ের গর্বের প্রতীক হয়ে আছে।

আইরিশ সংস্কৃতির গর্ব রিভারডান্স, ছবি: স্টার্ক ইনসাইডার
সালসা: ক্যারিবিয়ান ছন্দ আর আবেগের রঙিন জাদু
সালসা হলো লাতিন আমেরিকার প্রাণবন্ত এক যুগল নৃত্য, যার জন্ম মূলত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, বিশেষ করে কিউবা ও পুয়ের্তো রিকোতে। ছন্দময় পদক্ষেপ, শরীরী বাঁক আর ঘূর্ণনের মূর্ছনায় সালসা নাচ ভালোবাসা ও জীবনের উদযাপন প্রকাশ করে। আজ এটি বিশ্বের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় নাচের এক উজ্জ্বল মুখ।

ছন্দময় পদক্ষেপ, শরীরী বাঁক আর ঘূর্ণনের মূর্ছনায় সালসা যেন ভালোবাসা ও জীবনের উদযাপন, ছবি: লাইভ অ্যাবাউট
আর্জেন্টিনার ট্যাঙ্গো: ছন্দে বাঁধা আবেগের নীরব গল্প
ট্যাঙ্গো হলো আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের রাস্তায় জন্ম নেওয়া এক আবেগঘন যুগল নৃত্য। ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি, নাটকীয় পদক্ষেপ আর গভীর সঙ্গীতের মেলবন্ধনে এ নাচ ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার গল্প বলে। আজ ট্যাঙ্গো বিশ্বজুড়ে রোমান্টিক নাচের এক কালজয়ী প্রতীক।

আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের রাস্তায় জন্ম নেওয়া এক আবেগঘন যুগল নৃত্য, ছবি: উইকিপিডিয়া
নাচ হলো সেই ভাষা, যেখানে শব্দ নেই, তবু কথা হয়। ভূমি বদলায়, সংস্কৃতি বদলায়, কিন্তু তাল আর ছন্দের অনুরণন চিরকাল এক। নানান দেশের নানা নাচ আমাদের শেখায়, মানুষ কিভাবে আনন্দ আর আবেগকে শরীর দিয়ে ভাষায় রূপান্তর করে।