নতুন বছরের শুরুতে চলচ্চিত্র জগৎ হারিয়েছে দুই কিংবদন্তীকে। একজন অঞ্জনা রহমান আরেকজন প্রবীর মিত্র। তাদের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প অনেকেই জানেন। তবুও কতকিছু জানার মাঝেই অজানা থেকে যায়। সেই জানা অজানা মিলে একজন অঞ্জনা রহমান বা প্রবীর মিত্র যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন দর্শকদের মনে।
হ্যালো বাংলাদেশের এই বিশেষ আয়োজন নৃত্যপটিয়সী, আজীবনের নায়িকা অঞ্জনা রহমানকে নিয়ে।
ভারতে নাচের তালিম
ঢাকায় এক সংস্কৃতিমনা সাহা পরিবারে অঞ্জনার জন্ম। মাত্র চার বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। যখন কেউ হয়তো ভাবতেও পারতেন না, সেই আমলে, তার শৈশবেই, নাচের প্রতি তার আগ্রহের কারণে বাবা-মা তাকে নাচ শিখতে ভারতে পাঠান। ভারতে তিনি ওস্তাদ বাবুরাজ হীরালালের কাছে নাচের তালিম নেন, শেখেন কথক নৃত্যও। নৃত্যে তিনবার জাতীয় পুরস্কার লাভ ও একবার এশিয়া মহাদেশীয় নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনি।
সাহা থেকে রহমান
ক্যারিয়ারের শুরুতে তার নাম ছিল অঞ্জনা সাহা। পারিবারিক পদবী দিয়েই তার ফিল্মি ক্যারিয়ারের শুরু। এরপর কালের স্রোতে তিনি বিয়ে করেন এক সময়ের প্রভাবশালী প্রযোজক-পরিচালক আজিজুর রহমান বুলিকে। বাংলাদেশের ব্যবসা সফল সিনেমার অন্যতম এ প্রযোজক-পরিচালক বুলির পরিচালনায় তিনি ‘হিম্মতওয়ালী’, ‘নেপালি মেয়ে’, ‘বাপের বেটা’, ‘সন্দেহ’, ‘দেশ-বিদেশ’ ও ‘লালু সরদার’ মোট ছয়টি সিনেমায় অভিনয় করেন।
বিয়ের কারণে তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেন। বদলে যায় তার নামও। এমন কী, বিচ্ছেদের পরেও জীবনের শেষ অব্দি তিনি রহমান পদবী ব্যবহার করে গেছেন। গণমাধ্যমে এক সাক্ষ্যাৎকারে তিনি বলেন, নাম ও ধর্ম বিয়ের সময়ই বদলে গেছে। এখন আর ফেরার সুযোগ নেই। বরং তিনি পরিবর্তিত ধর্ম চর্চাও করতেন বলেও জানা গেছে।
৯ দেশের ১৩ ভাষার অভিনেত্রী
তিন শতাধিক সিনেমার অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান ৯টি দেশের ১৩টি ভাষার সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, তুরস্ক, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার সিনেমায় অভিনয় করেছেন। জীবদ্দশায় অঞ্জনা দাবি করেছিলেন, তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র নায়িকা যিনি ৯টি দেশের এতো ভাষায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৮৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অর্জুন ছবিতে অভিনয় করে তিনি প্রশংসিত হন।
এছাড়াও নিজের সময়কালে সকল শীর্ষ অভিনেতা-নায়কের সাথে অভিনয় করেছেন তিনি। মধ্যে আছেন- রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, ওয়াসিম, উজ্জ্বল, ফারুক, ইলিয়াস জাভেদ , ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরী, রুবেল, সুব্রত বড়ুয়া, মান্না, প্রমুখ। পাকিস্তানের অভিনেতা ফয়সাল নাদীম, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ; নেপালের শীবশ্রেষ্ঠ ও ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন এই নায়িকা।
প্রযোজক অঞ্জনা
অভিনয়ের পাশাপাশি অঞ্জনা চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলো হলো— ‘নেপালী মেয়ে’, ‘হিম্মতওয়ালী’, ‘দেশ-বিদেশ’, ‘বাপের বেটস’, ‘রঙিন প্রাণ সজনী’, ‘শ্বশুরবাড়ি’, ‘লাল সর্দার’, ‘রাজা রানী বাদশা’, ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’, ‘বন্ধু যখন শত্রু’।
লুকিয়ে লুকিয়ে আসা
কক্সবাজারের মেরিন সিটি শপিং মলের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে ভাইরাল তারকা বনে যান অঞ্জনা। আজীবন নায়িকার গেটআপ নিয়ে থাকা এই অভিনেত্রীর হাস্যরসাত্মক উপস্থিতি বিজ্ঞাপনের জনপ্রিয়তা কয়েকগুণ বারিয়ে দেয়। বলা হয়, এই শপিং মলের প্রচারণার কাজে অঞ্জনার ভূমিকা অনেক বেশি। তিনি বেশ দারুণভাবেই নিজের ইমেজকে ব্যহার করে প্রমাণ করেন, পর্দায় তার দাপট আজীবন অমলীন।
দুইবার জাতীয় পুরস্কারসহ যত অর্জন
১৯৮১ সালে ‘গাংচিল’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন অঞ্জনা। এরপর ১৯৮৬ সালে ‘পরিণীতা’ সিনেমায় ললিতা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে ফের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়া তিনি ‘পরিণীতা’, ‘মোহনা’ ও ‘রাম রহিম জন’ সিনেমার জন্য তিনবার বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।
রাজনীতির অঞ্জনা
সবার কাছে প্রিয়মুখ, পর্দার চিরসবুজ সুন্দরী অঞ্জনা রহমান রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও আওয়ামী সাংস্কৃতিক লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাবেক সরকারের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যায়।
সমালোচনা ও ফিরে আসা
২০২৪ সালে ছাত্র জনতার আন্দোলন, জুলাই বিপ্লবে তার রাজনৈতিক অবস্থান তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়। ফলে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখ দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। ফলে তার উপস্থিতি নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না কারও। অসুস্থ হওয়ার আগ অবধি তিনি বিভিন্ন মিলনমেলায় অংশ নিয়েছেন বরাবরের মতই।
মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন
অঞ্জনার মৃত্যুর পর তার শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র। গোসলের পর তার মরদেহ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে নেওয়া হলে সেখানেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়। তার শেষ বিদায়ের গোসলের সময়ে উপস্থিত সালমা হক নামের এক নিকটাত্মীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সকালে গোসল করানোর সময় আমি দেখি তার শরীরে বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন। যেগুলো দেখে আমার কাছে স্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। শুধু তাই নয় আপা আমাকে মাঝে বলেও ছিলেন কে বা কারা যেনো তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। যা নিয়ে তিনি বেশ ভয়ে ছিলেন। মাঝে আমাকে একদিন কল দিয়ে বলেন, দেখা করতে! কিন্তু সেই কথাটি শেষ পর্যন্ত আর শোনা হলো না।’
তার মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। জানা যায়, টানা ১০ দিন অচেতন অবস্থায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি ছিলেন। পরে ১ জানুয়ারি রাতে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। নায়িকার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, অসুস্থতার খবর তার পালিত ছেলে মনি কাউকে শুরুতে জানায়নি।
তবে এই হোক বিদায়
প্রশ্নের মুখে, বা কোনও অজানা কারণে, বিদায় সুর বেজে গেছে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়িকা অঞ্জনার। হঠাৎ করেই ২০২৫ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি পাড়ি জমান অজানা দেশে। যার জন্ম হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ২৭ জুন। হাতে কলমে যার বয়স মাত্র ৫৮ বছর! বালই ষাটের আগেই তিনি চলে গেলেন না বলে, কোন সংকেত ছাড়াই। এ যেন নায়িকার মঞ্চ ছাড়ার আগেই যবনিকাপাত।