Home বিনোদন জাফর ইকবাল ও একচল্লিশ বসন্তের বিবাগী গল্প

জাফর ইকবাল ও একচল্লিশ বসন্তের বিবাগী গল্প

ফারজানা জামান
১৪৯ views
জাফর ইকবালের বড় ভাই সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ এবং ছোট বোন সঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ।

গায়ক থেকে নায়কের যাত্রায় যিনি সফল, তার নাম জাফর ইকবাল। বেগি হাতার টি শার্ট। কখনো সাদা বা অন্যরঙের প্যান্ট। আশির দশকের পার্টি পোশাক যেন তার চিরচেনা কস্টিউম। রীতিমতো রকস্টার— এই হতে পারতো জাফর ইকবালের বর্তমানের ইন্সটাগ্রাম বায়ো। কিন্তু সেই বায়োর মালিক গত হয়েছেন ৩২ বছর আগে। থেমে গেছে রক যাত্রা। ‘ফুল স্টপ’ গানের আর চিত্রনাট্যের পাতায়।

১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাফর ইকবাল। তার বড় ভাই সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ এবং ছোট বোন সঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। গুলশানে বড় হওয়া জাফর ইকবালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। তার ভাষ্যমতে, তার বাসার জুতার সংখ্যা ছিল না হলেও তিন শতাধিক। পোশাক ও জুতার মাঝে সামঞ্জস্য থাকতো। নায়কের দুর্বলতা ছিল ব্র্যান্ডের জামা, দামি সিগারেট আর পারফিউমে। দিনে অন্তত ছয়বার জামা পাল্টাতেন আর সাত ধরনের পারফিউম ব্যবহার করতেন বলে উল্লেখ করেন কুমার বিশ্বজিৎ।

সঙ্গীতপ্রেমী এই পরিবারের তিন ভাই বোনের কেউই আর বেচে নেই। তবে থেকে গেছে তাদের শিল্পচর্চা আর ক্ষণস্থায়ী জীবনের সাফল্য।

‘চির সবুজ’ চার্মিং এই নায়ক ছিলেন নামকরা গিটারিস্ট। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই, বলা যায় কিশোর বয়স থেকে গিটার বাজাতেন আর গান করতেন। তার বোনও ভালো গান করতেন বলে পাবিবারিক সঙ্গীত সাধনা বেশ জমে যেত। একটা সময় ভালো গিটার বাজাতেন বলে প্রখ্যাত সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে অনেক ছবির আবহসংগীতও তৈরি করিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৬ সালে একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন জাফর ইকবাল। বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড গ্রুপ ‘র‍্যাম্বলিং স্টোনস’। এই ব্যান্ড নিয়ে বিভিন্ন শো করতেন তৎকালিন পাঁচতারা হোটেলসহ বিভিন্ন মঞ্চে। ১৯৬৯ সালে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে গিটার বাজিয়ে গান গাইবার সময় দর্শকের সারিতে ছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমান। চলতে চলতে হীরা খুঁজে নেবার মতোই তিনি পেলেন তার পরের সিনেমার নায়ককে। পরের সিনেমাতেই কাস্ট করলেন। আর গায়ক থেকে নায়ক হয়ে গেলেন জাফর ইকবাল।

এলভিস প্রিসলির ভক্ত এই নায়কের প্রথম সিনেমা ছিল ‘আপন পর’। নায়িকা ছিলেন কবরী। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালে। মিষ্টি এই জুটি সবার চোখে পড়ে যায় চট করে। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি ‘সূর্য সংগ্রাম’ ছবিতে ববিতার বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমাটির সিকুয়েল ছিল ‘সূর্য সংগ্রাম’। এরপরই এই জুটি বনে যায় পর্দার চিরকাঙ্ক্ষিত মুখ। যে মুখ বাস্তবেও একসাথে দেখতে চেয়েছিল তার ভক্তরা। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বছর দুয়েক আগে ববিতা নিজে একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে জাফর ইকবালের সাথে তার সম্পর্ক বিশেষই ছিল। দুজনের ভালো লাগাও ছিল। কিন্তু সেই গল্পটি যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ অবস্থাতেই হারিয়ে গেলো কালের স্রোতে।

১৯৭৫ সালে ‘মাস্তান’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় শুরু হয় নতুন যাত্রা। হয়ে গেলেন ড্যাশিং হিরো। এরপর অবশ্য ‘নয়নের আলো’ সিনেমার মাধ্যমে রোমান্টিক হিরোর মুকুটও ছিনিয়ে নেন রূপালি পর্দার।

তার অভিনীত ১৫০টি ছবির মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো— ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘পরিবর্তন’, ‘সিআইডি’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘ফুলের মালা’, ‘মর্যাদা’, ‘সন্ধি’, ‘ছোবল’, ‘প্রেম বিরহ’, ‘বন্ধু আমার’, ‘গর্জন’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘নয়নের আলো’।

এর মাঝে গানের চর্চা কমে গেলেও বাসায় ও বন্ধুদের মাঝে সুরের তালমেল থাকাতে গানের সাথে সম্পর্ক ছুটে যায়নি। এর মাঝেই প্লেব্যাক করেন। তার প্রথম সিনেমায় গাওয়া গান ছিল ‘পিচ ঢালা পথ’। ১৯৮৪ সালে জাফর ইকবালের কণ্ঠে ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ গানটি সে সময় জনপ্রিয়তা পায়।

গান-সিনেমায় আলোড়ন তোলা জাফর ইকবাল অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। বাংলাদেশের সে সময়ের অনেক তরুণ অভিনেতা খসরু, জসীম বা রাইসুল ইসলাম আসাদের মতো তিনিও গিটার ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে আবার ‘ওগো বিদেশীনি তোমার বেলি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও’ গানের মতো শিউলি তলায় যেন ফিরে আসেন।

জাফর ইকবালের স্টাইলিশ, সফল জীবনে সিনেমায় যেমন ট্র্যাজেডি আছে, তেমনই জীবনের আরেক প্রান্তে আছে সত্যিজীবনের কষ্ট। বাস্তব জীবনে দুই সন্তানের জনক জাফর ইকবাল হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। পানের নেশা তার শারীরিক ক্ষতি করতে থাকে। তার স্ত্রীর নাম সনিয়া, যিনি নায়কের মৃত্যুর পর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন। এদিকে ববিতার সাথে অসমাপ্ত প্রেমও তাকে কষ্ট দিয়েছে বলে দাবী করেছেন তার কাছের এক মানুষ।

১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল ‘অবুঝ হৃদয়’ ত্রিভুজ প্রেমের ছবিতে ববিতা ও চম্পার বিপরীতে অভিনয় করে আবারও আলোচনায় আসেন। এবারের বিষয় ছিল ববিতার সাথে তার রোমান্টিক দৃশ্য। এতটা সাবলীল ছিল যে উপস্থিত সকলে মনে মনে ধরে নেন যে, এ ছিল প্রেম ভেঙে যাবার ঠিক আগের আন্তরিকতার প্রকাশ।

তার গাওয়া গানে অনেকেই ববিতার প্রতি প্রেম, ভালোবাসা ও অভিমান খুঁজে পান। যেমন-  ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’। এই গানটি আজও অনেক প্রেমিক হৃদয়ের চিরপ্রিয় গান।

এছাড়াও সুরকার আলাউদ্দিন আলীর সুরে অনেক গান গেয়েছেন তিনি। তার গাওয়া শ্রোতা প্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’। ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি গেয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে। পরে রফিকুল আলমও এই গানটি গেয়েছিলেন। এই গানটির হৃদয়হীনাও সেই ববিতা কিনা- সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না।

এছাড়াও ৮০’র দশকে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছিল তার। সব মিলিয়ে তার মাত্র ৪১ বছরের জীবনের কাজের খাতা ছিল বর্ণিল। তবে কাছের মানুষের ভাষায় ব্যক্তিজীবন ছিলো ধুসর।

ববিতা একবার এক স্মৃতিচারণে জানান, তার জীবদ্দশায় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার নাম ছিল ‘লক্ষ্মীর সংসার’, যার ‘ভাই আজিমপুর যাব কীভাবে’ সংলাপটি ভক্তদের মনে খুব নাড়া দিয়েছিল। এই দৃশ্যে দেখা যায় নায়ক গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন। আজিমপুরে যাবার রাস্তা খুঁজছেন। ‘লক্ষ্মীর সংসার’ ছবিটি মুক্তির এক মাসের মাথায় জাফর ইকবাল মারা যান। সেই আজিমপুর কবরস্থানই হয় তার শেষ ঠিকানা।

১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি চলে যান নিজের সাজানো স্টাইলিশ জগত থেকে অনেকটা নিজের উপরে অভিমান করেই। তার সহকর্মীরা তাকে আজও মনে করেন। আর তার অসমাপ্ত গল্পের নায়িকা তথা ববিতাও মনে করেন, জাফর ইকবালের মতো পরিপূর্ণ নায়ক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দ্বিতীয়টি আসেনি, আসবেও না।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ