এক দেশে এক মামা ছিল। তার নানা রকমের শখ। কখনও তিনি মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করেন, কখনও আবার সিনেমা বানান। আবার এই বানানোর সঙ্গী-সাথী তারই ঘরের মানুষ। কখনও কাদের, কখনও রহিমার মা। কখনও আবার বোনের মেয়ে। এই নিয়ে তার সাথে দুলাভাইয়ের বিশাল গ্যাঞ্জাম। অবশেষে মামা পেলেন মনের মতো একটি কাজ। তা হলো টিয়া পাখিকে দিয়ে কথা বলানো। সেই টিয়া পাখি কথা বলল— ‘তুই রাজাকার’!
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ রচিত এই নাটকে ফরিদ মামার চরিত্রে অভিনয় করে হাস্যরসের মাধ্যমে এভাবেই ‘প্রতিবাদ’ ছড়িয়ে দেন ফরিদ মামা ওরফে আলী যাকের।
২৭ নভেম্বর তার প্রয়াণ দিবস। করোনা যত মানুষ কেড়ে নিয়েছে আলী যাকের তাদের অন্যতম। ২০২০ সালে তিনি চলে যান তার প্রিয় মঞ্চ ছেড়ে।
আলী যাকের কেবল একটি নাম নয়। বলা যেতে পারে একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি জীবনে অভিনেতার বাইরে তিনি বিজ্ঞাপনের মানুষও ছিলেন। ক্যামেরার সামনে নয়, একেবারে আইডিয়ার পেছনে। এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটির কর্ণধার ছিলেন। ছিলেন কলামিস্ট। নিয়মিত লিখতেন একটি জাতীয় দৈনিকে।
শুধু নাটকের চরিত্র নয়। বাস্তবজীবনেও তিনি ছিলেন প্রতিবাদী। তাকে থিয়েটারের বরপুত্র বলা হতো। কারণ তার মাধ্যমে থিয়েটারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি প্রথম মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের প্রদর্শনীও হয় তার হাত ধরে। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটক, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যপ্রদর্শনী।
তখন তার থিয়েটারে মোটে শুরু। তার এক বছর আগে ১৯৭২ সালে তিনি নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। এর প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। একই বছরের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ওই দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে।
এ তো গেল স্বাধীনতার পরের যাত্রা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি রওনা হয়েছিলেন অস্ত্র হাতে। কলকাতার পথে তার দেখা হয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আলমগীর কবিরের সাথে। তার পরামর্শে বুলেট ও বুদ্ধির ফৌজ গঠন করতে রাজি হয়ে যান আলী যাকের। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক ও উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শিল্পী হয়েই তিনি অবদান রাখেন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
তাই স্বাধীনতার পরে এই শিল্পকেই বানান পাথেয়। দীর্ঘ মঞ্চজীবনে অভিনয় করেছেন অনেক নাটকে। তার অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘বিদগ্ধ রমণীকুল’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘অচলায়তন’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’, ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’, ‘কবর দিয়ে দাও’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘কাঁঠাল বাগান’। এরমধ্যে নুরুলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বাংলাদেশের মঞ্চ ইতিহাসে অমর হয়ে গেছেন।
এছাড়া টেলিভিশনের নাটকে তাকে দেখা গেছে বিভিন্ন রকমের চরিত্রে। কখনও মামা, কখনও বড় ভাই, কখনও দুলাভাই রূপে।
এই মামা চরিত্রে অভিনয় করে তিনি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে যান যে, একবার গুরুগম্ভীর এক শোতে পিনপতন নীরবতায় কোনো এক শিশু দর্শক সারি থেকে বলে উঠে- মামা। তখন সেই নাটকের চরম সাসপেন্স– সবার মুখ থমথমে। শিশুর মামা ডাকে খিক খিক হাসি আর খুক খুক কাশিতে গোটা হল জেগে ওঠে। এদিকে অভিনেতার অবস্থা ছিল তথৈবচ। না পারছেন হাসতে, না পারছেন চরিত্রে ফিরে যেতে। আলী যাকের নিজেই এই গল্পটা বলেছিলেন একবার এক সাক্ষাৎকারে।
এরপর বড় ভাই হয়ে ‘আজ রবিবার’ নাটকে তিনি বিশ্ব বড় ভাই হয়ে গেলেন। যে কিনা মানসিক রোগের চিকিৎসক। আর তার প্রধান ছাত্র জাহিদ হাসান অর্থাৎ নাটকের আনিস। আর সেই ’হিজিবিজি’ সংলাপ হয়ে গেল একটি প্রজন্মের গোলমেলে অনুভূতি প্রকাশের শব্দ।
ওদিকে কেউ মানুক বা না মানুক, আলী যাকেরের মধ্যদিয়েই হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্রকে ফোটাতে চেয়েছেন- এটি অনেকেরই ধারণা। তার বেশিরভাগ নাটকেই পাগলাটে অবিবাহিত চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এমনকি ‘একদিন হঠাৎ’ নাটকেও তিনি খেপাটে মামার চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। প্রতিটা নাটকেই দেখা গেছে তাকে নিজের মতো কাজ করতে। যদিও তার ভাব প্রকাশের মাধ্যম হাস্যরস- তবুও ভাবটা ঠিকই হিমুর মতো হলদেটে।
ব্যবসায়িক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চকে সময় দিয়েছেন নিয়মিত। সময় দিয়েছেন টেলিভিশনেও। আবার সিনেমাতেও কাজ করেছেন। তার করা ছবির মধ্যে আছে ১৯৮৬ সালের ‘আগামী ‘ ১৯৯৬ সালের ‘নদীর নাম মধুমতী’, ২০০১ সালের ‘লালসালু’, ২০০৮ সালের ‘রাবেয়া’ ইত্যাদি।
তার বর্ণাঢ্য জীবনের মূল প্রাপ্তি দর্শকের ভালোবাসা বলে জানিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বহু আড্ডায়, আলোচনায় দর্শকের ভালোবাসা তুলে ধরেছেন তিনি। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এর বাইরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক এবং মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেছেন।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর জন্ম নেওয়া অসামান্য এই অভিনেতার জীবনে প্রাপ্তির খাতার পাতা অগণিত। স্ত্রী গুণী অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, ছেলে ইরেশ যাকের এবং মেয়ে শ্রেয়া সর্বজয়ার পাশাপাশি গোটা দেশই যেন তার পরিবারসম। কারণ ওই একটাই। তিনি কারও কারও কাছে বড় ভাই হলেও বাকি সবার স্মৃতিতে আজীবনের মামা। যার হাস্যরসে বের হয়ে আসে সমাজের সেই রূপ যা কঠোর বাংলাতেও বলা যায় না।