লাফিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ। গত আট বছরে দেশের মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এর জন্য বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত অপরিকল্পিত প্রকল্প ও দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। এসব ঋণ শেষ পর্যন্ত অতি দরিদ্রসহ কম আয়ের মানুষের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য মতে, চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট সরকারি ঋণ এই প্রথম ১০২ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন ১ লাখ কোটির সমান) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫.২৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মোট বৈশ্বিক ঋণের ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের দখলে।
আইএমএফের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। দেশটির মোট সরকারি ঋণ ১৬.৪৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা মোট বৈশ্বিক ঋণের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারের বিদেশি ঋণ ১৭৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ৩০৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট বৈশ্বিক ঋণের শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। বৈশ্বিক সরকারি ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশ ৪৩তম।
আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের হালনাগাদ তথ্য ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট গত শুক্রবার এ তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক সরকারি ঋণের পরিমাণ এরপর থেকে প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়বে। মূলত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির চাপে ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়বে।
আইএমএফ আরও বলেছে, চলতি ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট বৈশ্বিক জিডিপির ৯৩ শতাংশে উন্নীত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১০০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
আইএমএফের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপান। দেশটির মোট সরকারি ঋণ ১০.২২৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা মোট বৈশ্বিক ঋণের ১০ শতাংশ। এরপর রয়েছে যুক্তরাজ্য (৪র্থ, মোট সরকারি ঋণ ৩.৬৫২ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ), ফ্রান্স (৫ম, মোট সরকারি ঋণ ৩.৫৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ), ইতালি (৬ষ্ঠ, মোট সরকারি ঋণ ৩.২৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ৩ দশমিক ২ শতাংশ), ভারত (৭ম, মোট সরকারি ঋণ ৩.২৩১ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ৩ দশমিক ২ শতাংশ), জার্মানি (৮ম, মোট সরকারি ঋণ ২.৯৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ২ দশমিক ৯ শতাংশ), কানাডা (৯ম, মোট সরকারি ঋণ ২.৩৪৯ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ২ দশমিক ৩ শতাংশ) ও ব্রাজিল (১০ম, মোট সরকারি ঋণ ১.৯১৭ ট্রিলিয়ন ডলার, মোট বৈশ্বিক ঋণের ১ দশমিক ৯ শতাংশ)।
প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, দেশে দেশে রাজস্ব খাতের অনিশ্চয়তা বাড়ছে, সেই সঙ্গে কর সংগ্রহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতানৈক্য বাড়ছে। করনীতিতে পরিবর্তন আনা কঠিন হচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে বিভিন্ন কারণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যেমন পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় বৃদ্ধি, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণ, নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জসহ অন্যান্য উন্নয়ন ব্যয়।
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাড়ে ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২ দশমিক ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তহবিলের একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে থাকতে পারে।
তিনি বলেন, বিদেশি ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তিগুলো ব্যয়বহুল হয়। লুটেরারা বিদেশে অর্থ পাচার করে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও খারাপভাবে নির্বাচিত প্রকল্পগুলোও সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।
তার ভাষ্য, বিদেশি অর্থায়নে খুলনার রূপসায় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলেও প্রকল্পের জন্য গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। তাই প্রকল্পগুলো কাজে আসেনি। কিন্তু দেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ঋণ-জিডিপি অনুপাত বাড়ছে।