আজ আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এই দিবস পালনের পেছনে একটি গভীর ও মানবিক উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রতি বছর ২৮ মে এই দিবস পালন করা হয়। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো মা এবং নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। মাতৃমৃত্যুর হার কমানো এবং গর্ভাবস্থাকালীন ও প্রসবকালীন সময়কে আরও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত করে তোলা।
‘মা’ এই শব্দটি কেবল একটি সম্পর্ক নয়। এটি হলো ভালোবাসা, ত্যাগ ও সুরক্ষার প্রতীক। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে একজন মায়ের সুস্থতা ও সুস্থ মানসিকতার উপর। তাই মায়ের নিরাপদ মাতৃত্বকালীন সময় যেন নিরাপদ ও সুরক্ষিত হয়, তা নিশ্চিত করাই আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের মূল লক্ষ্য। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে পালিত এই দিবসটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি নারী যেন গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসা, পুষ্টি এবং সঠিক যত্ন পায়।
এটা শুধু তার অধিকার নয়, আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাও। একদিকে এই দিন সকল স্তরের মানুষকে নিরাপদ মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব সম্পর্কে যেমন সচেতন করে তোলা জরুরী। অন্যদিকে সরকার, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলে মাতৃমৃত্যু রোধে একসাথে কাজ করার প্রয়োজন।
বর্তমান চিত্র
ইউনিসেফ (UNICEF) এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে মা ও শিশু মৃত্যুহার এখনও একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর ১ লাখেরও বেশি শিশু পাঁচ বছরের আগে মারা যায়। যার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই প্রথম ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া, প্রতিবছর ৬৩,০০০-এর বেশি মৃত শিশুর জন্ম হয়। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অবস্টেট্রিক হেমোরেজ (রক্তক্ষরণ), হাইপারটেনসিভ ডিসঅর্ডার, অস্বাস্থ্যকর গর্ভপাত এবং অন্যান্য পরোক্ষ জটিলতা।
মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে হ্যালো বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ডাক্তার ফাওজিয়া মোসলেম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত বছর মাতৃমৃত্যু হারের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করলেও, সামগ্রিক চিত্র এখনো উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। নারী স্বাস্থ্য, বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের নিরাপত্তা ও পরিচর্যা বিষয়ে জাতীয়ভাবে নানা আলোচনা হলেও, মাঠপর্যায়ে তার কার্যকর বাস্তবায়নে শিথিলতা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। আমাদের প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্যগুলোর মাঝে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মা ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে তিনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শও দেন।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন
স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি টেকসই কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে মা ও শিশুর জন্য সহজে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমান সময়ে অনেক পরিবারই অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় যত্নের অভাব থেকে যাচ্ছে। পরিবার থেকেই মায়ের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার বিষয়টি গুরুত্ব পেলে পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হতে পারত।

স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি টেকসই কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন, ছবি: এনডিটিভি
মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির অভাব
অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণ নারীর নিজের পরিকল্পনার বাইরে ঘটে থাকে। এটি নারীর মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির ঘাটতি তৈরি করে। যার ফলে মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। নিরাপদ মাতৃত্বের পাশাপাশি সন্তান ধারণে নারীর মতামত ও প্রস্তুতি গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সচেতনতা এবং সহজলভ্যতা নিশ্চিত না হলে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির স্থবিরতা
এক সময়কার চলমান পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বর্তমানে প্রায় বন্ধের পথে। পুরনো কার্যক্রমগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে কার্যকর কিছু শুরু হয়নি। এই স্থবিরতা দীর্ঘমেয়াদে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ: পরিবেশগত দূষণ
বর্তমানে শিশু মৃত্যুর একটি বড় কারণ হচ্ছে শ্বাসনালীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও অন্যান্য পরিবেশঘটিত রোগ। এসব রোগের মূল কারণ বায়ু ও পানির দূষণ। যা আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় গরীব ও প্রান্তিক জনগণের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার অবকাঠামো ও জনবল—উভয়েরই সংকট রয়েছে। এটি একটি গুরুতর সংকট যা সমাধানে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
আমরা বর্তমানে একটি নাজুক এবং জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। স্বাস্থ্যখাতের এই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা, সম্পৃক্ততা ও কার্যকর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন জরুরি। সময় এসেছে, প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার।