যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শুরু হতে যাচ্ছে ‘অলিম্পিকস অফ আর্ট ২০২৪’। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন তৌহিন হাসান। এরপর দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দ্বিবার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আসরে (পেরু বিয়েনেল ২০২৪) অংশগ্রহণ করবেন তিনি। অলিম্পিকস অফ আর্টে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সাংবাদিক থেকে শিল্পী হওয়ার পথচলা— জীবনের এমন সব অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে হ্যালো বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়েছেন তৌহিন হাসান।
ক্যারিয়ার শুরু করেছেন সাংবাদিকতা দিয়ে। পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত হন লেখালেখির প্রতি ভালোবাসা থেকে। ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, টেলিভিশন নাটক— সবকিছু লেখার অভিজ্ঞতা আছে তার। গানের প্রতিও আছে অগাধ ভালোবাসা। গায়ক হিসেবেও অনেকের কাছেই পরিচিত তিনি। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্পচর্চা করে আসছেন তিনি। ফাইন আর্টসে পড়াশোনা শেষে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন।
মানুষকে একটি পরিচয়েই পরিচিত হতে হবে— এমন ধারণায় বিশ্বাসী নন তৌহিন। তাই লেখক, গায়ক, চিত্রশিল্পী কিংবা সাংবাদিক পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার চেয়ে নিজেকে শিল্পী বলতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি।
বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা আছে তার। ৯টা-৫টার রুটিন করা কোনো চাকরি কখনোই করেননি। তবে বেকারও ছিলেন না কখনও। কখনও ফ্রিল্যান্সিং, কখনও শিল্পচর্চা, আবার কখনও নতুন কিছু শেখা— সর্বদা কাজের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পান তৌহিন।
বর্তমানে পেইন্টিংয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন এই গুণী চিত্রশিল্পী। সেই সুবাদে ছবির অলিম্পিকে বিশ্বের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীদের সাথে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। প্রতি চার বছর পরপর এটি আয়োজন করে ‘আর্টিএইড’। বৈশ্বিক চিত্রশিল্পীদের অন্যতম মিলনমেলা ‘অলিম্পিকস অফ আর্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের লং আইল্যান্ড সিটিতে। সেখানে অবস্থিত রেইন ফরেস্ট ফাউন্ডেশনের দুটি আর্ট গ্যালারি ও সংশ্লিষ্ট এলাকাজুড়ে করা হবে এই আয়োজন। আগেরবার গ্রিসে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীতেই এবার অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে একমাত্র চিত্রশিল্পী তৌহিন হাসান।
তৌহিনের ‘সিটি নাইট’ সিরিজের চারটি চিত্রকর্ম এই আয়োজনে প্রদর্শিত হবে। উৎসবের পর্দা উন্মোচন ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে আগামী ১৫ নভেম্বর, চলবে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত। উৎসবে অংশ নিতে তৌহিন হাসান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন ১২ নভেম্বর। বিশ্বের ৮০টি দেশ থেকে প্রায় আড়াইশ চিত্রশিল্পী এই উৎসবে অংশ নেবেন। প্রদর্শিত হবে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ইন্সটলেশন আর্ট, স্ট্রিট আর্ট, আলোকচিত্র, ভিডিও আর্ট, মিক্সড মিডিয়া ও কনসেপচুয়াল আর্টসহ হাজারো শিল্পকর্ম।
আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য এ বছর মার্চ থেকেই আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। মে মাসে তিনি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পান। নির্বাচকরা তার ‘সিটি নাইট’ সিরিজের চারটি ছবি প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করেন। রাতের শহর ও নাগরিক জীবনে শহুরে রাতের প্রভাবের গল্পই ছবির মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন তৌহিন। ২০০৩ সাল থেকে এই সিরিজে ছবি আঁকা শুরু করেন তিনি। এটিই তার জীবনের প্রথম সিরিজ, তাই এই প্রদর্শনীতে সিটি নাইটের ৪টি ছবি নির্বাচিত হওয়ায় বেশ উৎসাহিত তিনি।

নিজেকে শিল্পী বলতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তৌহিন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
যুক্তরাষ্ট্রের প্রদর্শনী শেষে তৌহিন হাসান ডিজিটাল আর্টিস্ট হিসেবে আরেকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। ‘পেরু বিয়েনেল ২০২৪’ শীর্ষক এই এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে পেরুর রাজধানী শহর লিমায়, চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর। এটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আসর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২২,২৫৬ জন আবেদনকারী শিল্পী থেকে নির্বাচিত ৫৬০ জনকে নিয়ে এই আয়োজন।
শিল্পীরা তাদের চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, ডিজিটাল আর্ট, মিশ্র মাধ্যম, ভিডিও আর্ট থেকে শুরু করে নৃত্য, সংগীত ও থিয়েটার মঞ্চস্থ করবেন দ্বিবার্ষিক এই আয়োজনে। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র অংশগ্রহণকারী হিসেবে তৌহিন এতে অংশ নেবেন। ‘আমার ভাষা বাংলা-তোমার ভাষা কি?’ শিরোনামে তার ডিজিটাল আর্ট ও ডিজাইন সেখানে প্রদর্শিত হবে।
বিশ্বে অগণিত ভাষা প্রচলিত। ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যায়। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে এটি হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষা পৃথিবীর বুকে টিকে আছে অনেক বছর ধরে। এর জন্য জীবনও বিসর্জন দিয়েছেন বায়ান্নর ভাষা শহীদেরা। ‘আমার ভাষা বাংলা-তোমার ভাষা কি?’ শিরোনামে তার ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিজের ভাষার ইতিহাস যেমন বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারবেন তিনি, তেমনি বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের সাথে তাদের ভাষার অনেক অজানা গল্পও জানতে পারবেন।
বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য আগামী বছর এই দুটি বৈশ্বিক উৎসবে প্রদর্শন করা চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করবেন তিনি। তবে স্থান ও সময় এখনও নির্ধারণ করেননি।
তরুণ প্রজন্ম, যারা ভবিষ্যতে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের শিল্পকর্ম উপস্থাপন করতে চায় তাদেরকে বেশি বেশি কাজে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশ্ব মঞ্চে কাজ প্রদর্শনের জন্য আগে অনেক কাজ সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে করতে হবে। বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী এরকম আসরের খোঁজখবর রাখতে হবে। আর এখন এমন আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনেই সম্পাদন করা হয়। তাই কোনো স্বপ্নই এখন আর খুব বেশি দূরের নয়।
তৌহিন হাসানের জন্ম ১৯৭৮ সালে শরীয়তপুর জেলায়। শিল্পের নানা শাখায় কাজ করলেও তিনি চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ২০০৭ সালে, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) থেকে। চিত্রকলার পাশাপাশি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও সমান জনপ্রিয়। এছাড়া তিনি নিয়মিত কাজ করছেন ডিজিটাল আর্ট ও কমার্শিয়াল ডিজাইনে।
স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বার্জার তরুণ চিত্রশিল্পী অ্যাওয়ার্ড ২০০৪’ এবং সিডি কভার ডিজাইনের জন্য ‘সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ২০১১’। তার প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘দ্য আদার মুন’ অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার ‘লা’ গ্যালারিতে। এছাড়া তিনি দেশে-বিদেশে নানা চিত্রপ্রদর্শনীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে তিনি স্বাধীন চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন।