Home বিশ্ব নূহ নবীর সেই নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ পাওয়া গেছে!

নূহ নবীর সেই নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ পাওয়া গেছে!

মোহাম্মদ রবিউল্লাহ
১৫৫ views

হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা ও মহাপ্লাবনের গল্প শোনেননি এমন লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছেন। সৃষ্টিকর্তা মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে নূহ (আ.)-কে পাঠিয়েছিলেন। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের (সেমেটিক ধর্ম) অনুসারীদের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে নূহ নবী এমন একটি নৌকা বানিয়েছিলেন, মহাপ্লাবনের সময় যেটিতে আশ্রয় নিয়ে মানুষ ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণিকূল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল।

খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ও মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে নূহ (আ.)-এর নৌকা বানানোর প্রেক্ষাপট ও মহাপ্লাবনের বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু মহাপ্লাবনের পর বিশাল আকৃতির সেই নৌকার পরিণতি কী হয়েছিল? সেটির অস্তিত্ব কি এখনও টিকে আছে? যদি টিকে থাকে, তাহলে নৌকাটি এখন ঠিক কোথায় রয়েছে?— এমন নানান প্রশ্ন শত শত বছর ধরে মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

নূহ নবীর নৌকার অস্তিত্ব খুঁজতে যুগ যুগ ধরে অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান চালানো হয়েছে তুরস্কের আরারাত পর্বতে, যেটির উচ্চতা পাঁচ হাজার মিটারেরও বেশি। কারণ মহাপ্লাবনের পর এই পর্বতেই নূহের নৌকা নোঙর ফেলেছিল বলে খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নৌকার ধংসাবশেষ

কথিত নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষ, ছবি: বিবিসি

বিভিন্ন সময় সেখানে নূহের নৌকা খুঁজে পাওয়ার দাবিও করেছেন অনেকে। যদিও তাদের কেউই নিজেদের দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তবে তুরস্কে আরারাত পর্বতের দুরুপিনার সাইটে খননকাজ চালিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের বিশাল একটি নৌকার ‘ধ্বংসাবশেষ’ খুঁজে পাওয়া গেছে। সম্প্রতি গবেষকদের একটি দল এমন দাবি করেছে। আর এই নৌকাটি নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষ বলেই ধারণা তাদের।

‘মাউন্ট আরারাত অ্যান্ড নোয়াহ’স আর্ক রিসার্চ টিম’ নামের ওই গবেষক দলটি ২০২১ সালে কাজ শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্ড্রুস ইউনিভার্সিটির সাথে তুরস্কের ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং আরি ইব্রাহীম চেচেন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা যৌথভাবে দলটি গঠন করেন।

সম্প্রতি গবেষক দল আরারাত পর্বত খনন করার সময় মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন। খননের সময় মানুষের ব্যবহৃত ত্রিশটি উপকরণের নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। সেগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। প্রাথমিক ফলাফলে নমুনাগুলোর মধ্যে কয়েক হাজার বছরের পুরনো কাদামাটির উপকরণ, সামুদ্রিক খাবার ও সামুদ্রিক উপকরণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় উঠছে প্রাণিকূল

জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় উঠছে প্রাণিকূল, ছবি: বিবিসি

গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ফারুক কায়া তুরস্কের গণমাধ্যম হুরিয়েতকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, এটি থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০ থেকে ৩০০০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল। প্রাথমিকভাবে এটি নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষ বলেই মনে হচ্ছে।

তবে প্রাথমিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে জোর দিয়ে বলা যাবে না যে, নৌকাটি এখানেই রয়েছে। এছাড়া আসলেই ‘ধ্বংসাবশেষ’টি নূহের নৌকার কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

প্রাচীনকাল থেকেই চলছে অনুসন্ধান

প্রাচীনকাল থেকেই নূহ নবীর নৌকার অনুসন্ধান চলছে। ইহুদিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদ মতে, আসেরীয় রাজা সেন্নাকেরিব খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে নূহের নৌকার খোঁজে জুদি পর্বতে উঠেছিলেন। তিনি সেখানে নৌকার একটি কড়িকাঠ খুঁজে পেয়েছিলেন বলেও গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের দিকেও যে মানুষ নূহের নৌকার অনুসন্ধান করছিলেন, সেটি জানা যায় তৎকালীন ইতিহাসবিদ ইউসেবিয়াসের গ্রন্থ থেকে।

এরপর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতিহাসবিদ ফস্টাস তার ‘হিস্ট্রি অব দ্য আর্মেনিয়ানস’ গ্রন্থে সেন্ট জ্যাকব নামের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি লোককাহিনীর উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, নূহের নৌকার সন্ধানে সেন্ট জ্যাকব আরারাত পর্বতে উঠেছিলেন।

বরফে আবৃত পর্বত

বরফে আবৃত তুরস্কের আরারাত পর্বত, ছবি: বিবিসি

তিনি যখন চূড়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছান, তখন একজন স্বর্গীয় দূত স্বপ্নে এসে তাকে পর্বতের মাথায় উঠতে নিষেধ করেন। সান্ত্বনাস্বরূপ সেই স্বর্গীয় দূত জ্যাকবকে নূহের নৌকার একখণ্ড কাঠ এনে দেন। সেই কাঠ নিয়ে জ্যাকব শহরে ফিরে আসেন, যা এখনও আর্মেনিয়ার একটি প্রাচীন গির্জায় সংরক্ষিত রয়েছে বলে খ্রিস্টানদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। তবে কাগজপত্রে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আরারাত পর্বতে ওঠার ক্ষেত্রে যার নাম পাওয়া যায়, তিনি হচ্ছেন বাল্টিক-জার্মান প্রকৃতিবিদ ও পর্বতারোহী ফ্রেডরিখ প্যারোট।

১৮২৯ সালে তার নেতৃত্বে একটি দল প্রথম এই পর্বতের চূড়ায় আরোহন করে। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘জার্নি টু আরারাত’ গ্রন্থে প্যারোট লিখেছেন, আর্মেনিয়ার মানুষরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, নূহের নৌকাটি এখনও আরারাত পর্বতের চূড়ায় রয়েছে।

তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, সংরক্ষণের স্বার্থেই নৌকাটির কাছে কোনো মানুষকে যেতে দেওয়া হবে না। এরপর ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ গবেষক ও রাজনীতিবিদ জেমস ব্রাইস আরারাত পর্বতে আরোহন করেন।

তিনি দাবি করেছিলেন, পর্বতে তিনি চার ফুট লম্বা ও পাঁচ ইঞ্চি পুরু একটি কাঠের টুকরো দেখতে পেয়েছেন, যেটি কোনো একটি হাতিয়ার দিয়ে কাটা হয়েছে। ১৯৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রকাশিত নিউ ইডেন নামের একটি পুস্তিকায় ‘নূহর নৌকা পাওয়া পাওয়া গেছে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়।

নূহ আ

ইরান-তুরস্ক সীমান্ত থেকে ২ মাইলেরও কম দূরে অবস্থিত আরারাত পর্বত, ছবি: দ্য ব্রাইটার সাইট

সেখানে বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভ্লাদিমির রোস্কোভেটস্কি নামের রাশিয়ার একজন বৈমানিক আরারাত পর্বতের ওপর দিয়ে বিমান চালিয়ে যাওয়ার সময় একটি হ্রদ দেখতে পান। সেই হ্রদের তীরে তিনি একটি বিশাল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখেতে পেয়েছিলেন বলেও নিবন্ধটিতে দাবি করা হয়।

১৯৫৯ সালে তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীর একটি বিমান নিয়ে আরারাত পর্বত অঞ্চলে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ চালিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ইলহান দুরুপিনার। তখন আরি প্রদেশের দোবায়েজিত এলাকায় তিনি ‘নূহের নৌকা’র মতো দেখতে একটি অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে দাবি করেন।

কল্পনা

শিল্পীর কল্পনায় হযরত নূহ (আ.)- এর নৌকা ও প্রাণিকূল, ছবি: বিবিসি

এ ঘটনার পর কথিত নূহের নৌকার ধ্বংসাবশেষকে দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ওই এলাকায় ভিড় করতে শুরু করে। জায়গাটি ‘দুরুপিনার সাইট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। গবেষকরাও বিভিন্ন সময়ে সেখানে অনুসন্ধান চালিয়েছেন।

এটি করতে গিয়ে কেউ কেউ নিখোঁজও হয়েছেন। তেমনই একজন হচ্ছেন ডোনাল্ড ম্যাকেঞ্জি। স্কটল্যান্ডের নাগরিক ম্যাকেঞ্জি ২০১০ সালে নূহের নৌকার অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিখোঁজ হন।

বিবিসি ও দ্য ব্রাইটার সাইট থেকে অনূদিত 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ