Home টপ পোস্ট বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় যেসব কৌশলে

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় যেসব কৌশলে

ইকবাল হোসেন
৩৩৮ views

বাংলাদেশের অর্থনীতি যেসব অপঘাতে জর্জরিত, তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থ পাচার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। নানা কৌশলে এসব অর্থ পাচার করে অসাধু ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে আমদানি-রফতানি। কখনও পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে, আবার কখনও মূল্য বেশি দেখিয়ে আমদানি-রফতানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া বিনিয়োগের নামেও পাচার করা হয় অর্থ। এসব পন্থায় অর্থ পাচার করে থাকেন মূলত দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী জড়িত তারা।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের আরেকটি বড় মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। পাশাপাশি নগদ ক্যাশও পাচার হয় ব্রিফকেসের মাধ্যমে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দুই পন্থায় বেশি অর্থ পাচার করে থাকেন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং আমলারা। কারণ তারা প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় হয়তো তাদের ব্রিফকেস চেক করার সাহসই হয় না বিমানবন্দরে দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় কয়েকটি মাধ্যমে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে আমদানি-রফতানি। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন মূলত দেশের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের আরও দুটি পন্থায় অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে, আরেকটি হচ্ছে বিদেশে বিনিয়োগের কথা বলে। এর বাইরে আরও দুটি গ্রুপ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। একটি গ্রুপ হচ্ছে সরকারি আমলা, আরেকটি গ্রুপ হচ্ছে রাজনীতিবিদ।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অর্থ পাচারের ওপর সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের সাতটি কৌশলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো— (১) আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), (২) রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), (৩) কম ঘোষণায় বেশি পণ্য রপ্তানি, (৪) বেশি ঘোষণায় কম পণ্য আমদানি, (৫) কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি, (৬) ভুয়া রপ্তানি এবং (৭) শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানিতে জালিয়াতি।

ml

ছবি: ফ্রীপিক

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সন্ধান পেয়েছে, রপ্তানিতে সরকার যে প্রণোদনা দেয় তা হাতিয়ে নিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকে। রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে সরকার পণ্যভেদে ১ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য ও ওজন বাড়তি দেখিয়ে প্রণোদনার অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- গত বছরের মার্চে সাগর জুট ডাইভারসিফাই ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসে ১৮ হাজার পিস (ওজন বলা হয়েছে ২ হাজার ৩১২ কেজি) পাটের তৈরি ডোর ম্যাট রপ্তানির ঘোষণা দেয়, যার রপ্তানি মূল্য দেখানো হয় ৮১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ১৮ হাজার পিসের জায়গায় পাওয়া যায় মাত্র ৬ হাজার ১১৬ পিস (যার ওজন ২৪৪ কেজি) এবং পাটের তৈরি ডোর ম্যাটের পরিবর্তে পাওয়া যায় পাটের তৈরি ন্যাপকিন, যার মূল্য মাত্র ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। যদি প্রতিষ্ঠানটি এই চালান রপ্তানি করতে পারলে সরকারের কাছে প্রায় ১৬ লাখ টাকা প্রণোদনা দাবি করতে পারত।

আন্ডার ইনভয়েসিংও অর্থ পাচারের একটি কৌশল বলে মনে করে শুল্ক গোয়েন্দা। আন্ডার ইনভয়েসিংটা হয় মূলত রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে। আপনি আপনার রপ্তানি পণ্যের মূল্য ঘোষণা করলেন ১০০ ডলার, অথচ এর প্রকৃত মূল্য ১৫০ ডলার। এ বাড়তি ৫০ ডলার আপনার পণ্যের ক্রেতা বিদেশে আপনার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেবে। তবে যেসব পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা থাকে না, সাধারণত সেসব পণ্য রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়ে থাকে। শুল্ক গোয়েন্দা এমন তথ্য পেয়েছে। ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে টি-শার্ট রপ্তানির জন্য কাস্টমসে বিল অব এক্সপোর্ট জমা দেয়, যাতে টি-শার্টের মূল্য ১২ টাকা (১২ সেন্ট) ঘোষণা দেওয়া হয়। সাধারণত এত কম মূল্যে টি-শার্ট রপ্তানি করা হয় না। মূলত অবৈধভাবে অর্থ বিদেশে রেখে দিতেই এ পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মনে করে।

চতুর্থ কৌশলটি হচ্ছে, কম ঘোষণা দিয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করা। গত বছরের জানুয়ারিতে একটি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসে ৬০ হাজার পিস তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে বিল অব এক্সপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় ১ লাখ ২৭ হাজার পিস তৈরি পোশাক পাওয়া যায়। অতিরিক্ত এ ৬৭ হাজার পিস তৈরি পোশাকের মূল্য পাচার হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। আবার বেশি ঘোষণা দিয়ে কম পণ্য রপ্তানির ঘটনার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

নমুনা ঘোষণা আরেকটি কৌশল। প্রতিবেদন বলছে, নমুনা ঘোষণায় পুরো কনটেইনার ভর্তি পণ্য পাঠানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন নামকরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ই-এক্সপি জাল করা হচ্ছে। নমুনা পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে কাস্টমসে মূল্য, এক্সপোর্ট এলসি, কন্ট্রাক্ট ও সেলস অর্ডার উল্লেখ থাকে না। সেক্ষেত্রে কোনো অর্থই দেশে ফিরে না এসে পুরোটাই বিদেশে থেকে যায়। যেমন- তিনটি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ৩৭৯ কোটি টাকা, ২৮২ কোটি টাকা এবং ৬২ কোটি টাকার নমুনা পণ্য বিদেশে পাঠিয়েছে, কিন্তু কোনো অর্থই দেশে ফিরে আসেনি।

অর্থ আত্মসাতের সর্বশেষ যে কৌশলটির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে, তা হলো বিদেশে পণ্য রপ্তানি না করেও শুধু কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে কর্ম উদ্ধার করা। একটি প্রতিষ্ঠান ১১১টি চালান বিদেশে রপ্তানি করে। এ রপ্তানির বিপরীতে ৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু কাস্টমসের তদন্তে উঠে আসে এ প্রতিষ্ঠানটি কখনও পণ্য রপ্তানি করতে অফডক বা বন্দরে কনটেইনার পাঠায়নি। এমনকি কোনো কনটেইনার রপ্তানিও হয়নি। শুধু বিল অব এক্সপোর্ট, এলসি, ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট জালিয়াতির মাধ্যমে বানিয়ে প্রণোদনার ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে।

একই ধরনের একাধিক জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই কায়দা করে জান্নাত করপোরেশন ১৭৮টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে ৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং ফাতিমা করপোরেশন ৬৮টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রণোদনা হাতিয়ে নিয়েছে।

এভাবেই চলছে রপ্তানির নামে অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ এবং তা দিনের পর দিন চলছে। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও সরকারি প্রণোদনা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার প্রবণতা রোধকল্পে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সুস্পষ্ট ছয়টি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে— রপ্তানি পণ্য চালান পরীক্ষা ও শুল্কায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার মাধ্যমে পণ্যের মূল্য ও সঠিকতা যাচাইয়ের মাধ্যমে রপ্তানির অনুমতি দিতে কাস্টমস হাউজগুলোকে নির্দেশ দেওয়া; রপ্তানি পণ্যের ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য, মজুরি, কারখানার ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় ক্যাটাগরিভিত্তিক পণ্যের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা; পাশাপাশি রপ্তানি পারমিট ইস্যুর আগে বিবরণ ও পরিমাণের ভিত্তিতে পণ্যের প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে কিনা, তা ব্যাংক বা রপ্তানি পারমিট ইস্যুকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা।

অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হুন্ডি
বাংলাদেশে থেকে সব ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের অর্থ পরিশোধের জন্য হুন্ডির ব্যবহারই বেশি। অর্থ পাচার বাড়ছে বলে হুন্ডিও বেড়েছে। তবে যারা ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত, তারা অর্থ পাচার করে মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। আর যারা ঘুষ-দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালান বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন, তারা অর্থ পাচারের জন্য বেছে নেন হুন্ডিকেই।

হুন্ডি ব্যবসা সাধারণত মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এর ফলে অর্থপাচার ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। হুন্ডি ব্যবস্থায় লেনদেনের কোনো রেকর্ড না থাকায় এটি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই ব্যবসা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত করে। হুন্ডি ব্যবসায় সাধারণত দ্রুত এবং কম খরচে টাকা পাঠানো যায়। তবে কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণের আওতায় নয় এবং প্রায়ই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। হুন্ডি ব্যবস্থার কারণে কর ফাঁকি এবং আর্থিক অপরাধ ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ থেকে বছরে ২৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার অবৈধ পথে লেনদেন হয়। আর এ কারণেই এখানে হুন্ডির এত প্রসার।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের বড় উৎস হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, যেমন চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি ও দ্রুত অবলোপন, জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে কর্মরতদের বিদেশিদের অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন এবং বৈধ আয় হলেও কর ফাঁকি দিয়ে ও প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন লঙ্ঘন করে তা পাচার।

আর অর্থ পাচারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে— আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের উঁচু মানের জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ।

টাকা পাচার  সম্পর্কে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, যারা অর্থ পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে এ প্রবণতা থামানো সম্ভব হবে না। অসৎ ব্যবসায়ী, কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তা— এ ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই অর্থ পাচার সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে অর্থ পাচারের যেসব ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, সেসব ঘটনায় জড়িত কাস্টমস ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ