Home বাণিজ্য বৈষম্যহীন দেশ গড়ার বাজেট

বৈষম্যহীন দেশ গড়ার বাজেট

ইকবাল হোসেন
৪০ views

সোমবার (২ জুন) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে  অস্বস্তির পাশাপাশি স্বস্তিও আছে।

এদিন বেলা ৩টায় তিনি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। সংসদ না থাকায় এবারের বাজেট বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টার ভাষ্যে, একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কিছুটা সংস্কারভিত্তিক এই বাজেটে উন্নয়নের সুফল সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পরিকল্পনা থাকছে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি।

সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটা যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়নও হবে এ বাজেটের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে অনেকে মনে করছেন গতানুগতিক বাজেটই দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। 

মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
বাজেটে মূল্যস্ফীতির গড় হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগি সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা মূল্যস্ফীতিকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে। মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই এক নম্বর অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ করদাতাদের আয়করে  ছাড় দেওয়া হয়নি। বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তাই রাজস্ব বাড়াতে মূল্য সংযোজন কর এবং আয়করে বাড়তি নজর দিচ্ছে সরকার। তবে দেশের প্রেক্ষাপটে আয়কর খাতে রাজস্ব বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং হওয়ায় খড়গ গিয়ে পড়ে ভ্যাটে। এতে করে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্য
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণসহ মধ্যমেয়াদে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, কর অব্যাহতি সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা, করজাল সম্প্রসারণ, বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবায় যথাসম্ভব একই হারে ভ্যাট নির্ধারণের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।

সরকার ব্যয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তার বড় অংশই—৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে চায় অভ্যন্তরীণ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির মাধ্যমে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস থেকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য রয়েছে।

এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে বিভিন্ন খাত থেকে কর অব্যাহতি কমিয়ে। বাকি ৪৬ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআর-বহির্ভূত কর খাত থেকে। এ জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে করকাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার, কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে সরে আসা এবং ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। করজালের আওতাও সম্প্রসারণের উদ্যোগ রাখা হচ্ছে।

ব্যতিক্রমী যত উদ্যোগ
জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ তহবিল করা হয়েছে। এর জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকায় মাসিক ভাতা, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা খরচ, ফ্ল্যাট ও কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

বর্তমানে স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষের জন্য স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গেজেটভুক্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এ আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন অথচ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন, এমন ব্যক্তির বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করে নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের বিধান রাখা হচ্ছে বাজেটে।

সমালোচিত উদ্যোগ
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল ভবিষ্যতের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা প্রদর্শিত (সাদা) করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে শেষ পর্যন্ত কালোটাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে। তবে আগের মতো ঢালাওভাবে নয়; কেবল স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোরস্পেস ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান করহার সর্বোচ্চ সাত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বাজারমূল্যে দলিল নিবন্ধন উৎসাহিত করতে এ সুপারিশ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

যেসব নীতিতে পরিবর্তন আসছে
আগামী অর্থবছরে প্রথম থেকে নবম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ১০ থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ২০১৫ সালের পর এখন পর্যন্ত কোনো বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের চলমান আটটি কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাঁদের সন্তানদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে নতুন করে।

বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাজেটে। আর জুলাই শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য এককালীন অর্থের পাশাপাশি মাসিক ভাতা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের।

এ ছাড়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আরও বড় করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমানে এ কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ পরিবারের কাছে কম দামে চাল বিক্রি করা হয়। আগামী অর্থবছরে বিক্রি করা হবে ৫৫ লাখ পরিবারের কাছে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে চাল বিক্রি করা হয় বছরে পাঁচ মাস। এটা বাড়িয়ে ছয় মাস করা হচ্ছে।

বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার (বছরে লেনদেন) হয় এমন প্রতিষ্ঠানকে লাভ-লোকসান নির্বিশেষে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে।

জমি কেনাবেচার ওপর কর এলাকাভেদে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে, যা এখন ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ। ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হলেও বর্তমানে যে করহার আছে, তা এলাকাভেদে কয়েক গুণ বাড়ানো হতে পারে।

আরো যত পরিসংখ্যান
নতুন অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ও ঋণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে উল্লেখ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার কথা জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটটি আত্মনির্ভর না হওয়ায় সম্ভাব্য ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির পুরোটাই আসবে ঋণ থেকে। এর মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। আর দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৬ হাজার কোটি টাকা আসবে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও দাতাদেশগুলোর দেওয়া অনুদান থেকে।

অন্যদিকে অতীতে ঋণ করে বড় আকারের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগের কারণে বেড়েছে বৈদেশিক দায়ের বোঝা। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের দায় বয়ে বেড়াচ্ছে দেশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এ দায় পরিশোধেরও বাধ্যবাধকতা থাকছে। এ জন্য আগামী বাজেটে সরকারি পরিচালন ব্যয়ের ১৭ শতাংশ বা ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকাই বরাদ্দ রাখা হচ্ছে আগের ঋণ ও সুদ পরিশোধে।

এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও নতুন করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার জন্য সরকার ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার লক্ষ্যে বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। আর সরকারি দাপ্তরিক কাজের সামগ্রী ক্রয় ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় করা হবে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ