ফ্যাশন এবং বিউটির মতো সিনেমারও ট্রেন্ড আছে। গত কয়েক বছর ধরে হলিউড সিনেমা শিল্পে চলছে “ইট দ্য রিচ” ট্রেন্ড। — এই বাক্যটি শুধুমাত্র একটি ট্রেন্ড বা স্লোগান নয়, বরং এটি একটি বিদ্রোহী দর্শন, যা শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই থিওরিটি সাম্প্রতিক সময়ের বহু সিনেমায় উঠে এসেছে একধরনের রাজনৈতিক বিবৃতি হিসেবে, যেখানে ধনী শ্রেণির নিষ্ঠুরতা, লোভ ও অমানবিকতার পাশাপাশি তাদের অযৌক্তিক অতিরঞ্জিত জীবনযাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
কী এই ‘ইট দ্য রিচ’ থিওরি?
‘ইট দ্য রিচ’ (Eat the Rich) মূলত একটি বিপ্লবাত্মক স্লোগান, যার উৎস ফরাসি বিপ্লবের সময়কালে। ধারণাটি ছিল এমন— যখন ধনীরা জনগণের দুঃখ-কষ্টে উদাসীন থাকে, তখন একসময় গরীবরা তাদের ‘খেয়ে ফেলে’। আধুনিক সংস্কৃতিতে এই বাক্যটি ব্যবহৃত হয় প্রতীকী অর্থে— ধনী ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক হিসেবে।
সিনেমায় এই থিওরির প্রতিফলন
বিগত এক দশকে “ইট দ্য রিচ” থিওরির ছায়া বিশেষভাবে দেখা গেছে নানা ধরণের চলচ্চিত্রে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই থিওরি নতুন জীবন পেয়েছে বড় পর্দায়। চলুন এই তত্ত্ব-প্রাণিত সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত কিছু জনপ্রিয় সিনেমা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
প্যারাসাইট (২০১৯)
বং জুন-হো পরিচালিত এই দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্রে নিম্নবিত্ত পরিবার কিমরা এক উচ্চবিত্ত পরিবার পার্কদের বাড়িতে চাকরি পায় এবং ধীরে ধীরে সেই পরিবারটিকে চালনা করতে থাকে। সিনেমার শেষ দিকে ধনী ও গরীবের মধ্যকার সংঘাত ভয়াবহ পরিণতি নেয়। এখানে ‘ইট দ্য রিচ’ প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠে— গরীবদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যখন ফেটে পড়ে, তখন তা ধ্বংস ডেকে আনে। ইতিহাস গড়ে ২০২০ সালে ‘প্যারাসাইট’ বিদেশি সেরা চলচ্চিত্র এবং সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার অর্জন করে। বলা যায় এই সিনেমার পর থেকেই হলিউড জোরসে ‘ইট দ্যা রিচ’ থিওরির চর্চা শুরু করে।

প্যারাসাইট সিনেমার দৃশ্য, ছবি: দ্যা নিউ ইয়র্কার
জোকার (২০১৯)
টড ফিলিপস ২০১৯ সালে ডিসি কমিক্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিলেন জোকারের অরিজিন স্টোরি নিয়ে সিনেমা নির্মান করেন। এই সিনেমায় আর্থার ফ্লেক নামক এক সমাজবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে আমরা দেখতে পাই, যার দুঃখ, বঞ্চনা ও অবহেলা শেষ পর্যন্ত তাকে সহিংস বিদ্রোহের মুখপাত্র করে তোলে। গোথাম শহরে যখন ধনী ও গরীবের ব্যবধান চরমে পৌঁছে, তখন আর্থারের সহিংসতা এক গণ-বিদ্রোহের রূপ নেয়। এই আর্থার ফ্লেক হয়ে ওঠেন জোকার।

জোকার ওরফে আর্থার ফ্লেক চরিত্রে ওয়াকিন ফিনিক্স, ছবি: এইচকিউ ওয়ালস
ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস (২০২২)
রুবেন অস্টলান্ড পরিচালিত এই ব্ল্যাক কমেডিতে একটি বিলাসবহুল ইয়টে যাত্রীদের শ্রেণিগত ভেদাভেদকে ঘিরে একটি অসাধারণ শ্রেণিচিত্র ফুটে ওঠে। যখন পরিস্থিতির পরিবর্তনে নিম্নবিত্ত কর্মচারীরা ক্ষমতা অর্জন করে, তখন ‘ইট দ্য রিচ’-এর বাস্তবায়ন ঘটে উল্টানো বাস্তবতায়।
দ্যা মেনু (২০২২)
এই থ্রিলার-স্যাটায়ারে এই চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে শ্রেণিসংঘাতের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেখানে ধনীদের ঔদ্ধত্যের জন্য মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ‘মূল্য চোকাতে হয়’। সিনেমাটিতে দেখা যায় কিছু উচ্চবিত্ত অতিথি, যাঁরা নামিদামি, কুখ্যাত বা এমনিতে অনেক ধনী, যারা একটি এক্সক্লুসিভ দ্বীপে এসে বসেন বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী স্লোয়িকের রান্না উপভোগ করতে। শুরুতে একে একটি এলিট ‘ফাইন ডাইনিং’ অভিজ্ঞতা মনে হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তা হয়ে দাঁড়ায় এক ঘৃণা ও প্রতিশোধের থিয়েটার।

ধনীদের ‘গিলে খাওয়ার’ আগে ভালোমন্দ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছেন শেফ স্লোয়িক, ছবি: এসএফ ক্রোনিকেল ডেটবুক
স্লোয়িককে এখানে দেখানো হয় একজন শ্রেণী বিপ্লবী হিসেবে যে তিনি নিজে একসময় সাধারণ মানুষের সন্তান ছিলেন, এবং বহুদিন এলিটদের খুশি করতে করতে তিনি বুঝেছেন—তারা শিল্পের কদর করে না, শুধু ক্ষমতার প্রদর্শনী চায়। তিনি একে একে প্রত্যেক অতিথিকে তাদের পাপের কারণে নৈতিক ও শারীরিকভাবে “শাস্তি” দেন। এই শাস্তি শুধুমাত্র মৃত্যুর নয়—এটি বেইজ্জতির, মূল্য হারানোর, এবং নির্বুদ্ধিতার নগ্ন প্রদর্শনী।
গ্লাস অনিয়ন (২০২২)
রায়ান জনসনের ২০২২ সালের ফিল্ম গ্লাস অনিয়নঃ দ্যা নাইভস আউট মিস্ট্রি শুধু একটি মজার রহস্যকাহিনি নয়—এটি মূলত একটি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, বিশেষত “ইট দ্য রিচ” ধারণার আধুনিক সংস্করণ। “ইট দ্যা রিচ” একধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্লোগান, যা ধনীদের ওপর ক্ষোভ, সমালোচনা ও বিদ্রুপ প্রকাশ করে। ‘গ্লাস অনিয়ন’ এই বক্তব্যকে রঙিন রহস্য ও ব্যঙ্গের মোড়কে উপস্থাপন করেছে।

‘গ্লাস অনিয়ন’ সিনেমার পোস্টার, ছবি: পপকাল্ট রিভিউস
দর্শক কেন এত আকৃষ্ট?
এই ধরনের সিনেমাগুলি শুধু বিনোদন নয়— বরং সমসাময়িক সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক অসন্তোষ, বৈষম্য এবং অবিচারকে প্রতিফলিত করে। “ইট দ্য রিচ” সিনেমাগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এমন এক কল্পনার পরিসর পান, যেখানে অবিচার বা শোষণের জবাব পাওয়া যায়, যদিও তা কাল্পনিক এবং প্রায়শই সহিংস।
‘ইট দ্য রিচ’ থিওরি আধুনিক সিনেমায় একধরনের শ্রেণিসচেতনতার ভাষ্য হয়ে উঠেছে। এটি শুধু একটি থিম নয়— এটি একটি বার্তা, এক ধরণের প্রতিরোধ। সিনেমার মাধ্যমে এই ক্ষোভের চিত্রায়ণ সমাজে বিতর্ক তৈরি করে, প্রশ্ন তোলে, আর কখনও কখনও— পরিবর্তনের আগুন ছড়িয়ে দেয়। শ্রেণিসংঘাত, বৈষম্য, এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে “ইট দ্য রিচ” থিওরি শুধু একটি গল্প বলার কৌশল নয়, বরং এটি এক প্রজন্মের দ্রোহের প্রতিধ্বনি।