Home বিনোদন কারাগার থেকে কাকতাল

কারাগার থেকে কাকতাল

ফারজানা জামান
১৭৯ views
২০২১ সালের ২০ আগস্ট থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে কাকতাল ব্যান্ড

গুগলে নাম লিখে সার্চ দিলে শিল্পীদের কেন্দ্র করে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের শিরোনাম। কারও গান, কারও কবিতা, কারও আবার ‘কী করছেন’ তা নিয়ে বিশাল খবর। অথচ কাকতাল লিখলে আসে কারাগারের গল্প। যে কারাগারে আসামিদের বসবাস, যে কারাগারে শুধু গ্লানি আর অথর্ব সময়, সেই কারাগারেই জন্ম কাকতালের।

এই গল্প এই সময়ের শ্রোতাপ্রিয় ব্যান্ড কাকতালের। জন্ম অন্ধকারে হলেও বর্তমানে মঞ্চে তারাই থাকেন মূল ফোকাসে। একেবারেই আজব কাণ্ড! আর তাদের এই আলাপের কিছু অংশ ‍জানা গেল আজব কারখানার গীতি-গায়েন-সুরকারদের নিয়ে আয়োজনে। এই আয়োজনে তারাই গান পরিবেশন করেছেন যারা নিজেরাই গান লেখেন আর গান করেন। সেই সুবাদে কাকতালও এর অংশ।

ব্যান্ডটি যখন তৈরি হয়, তখন এর সদস্যদের সবাই কারাবন্দী। গিটারিস্ট-ভোকাল আসিফ ইকবাল অন্তুও তাই। ব্যান্ডটি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান সবাই বিনয়ের সাথে স্বীকার করেন। এরপরের গল্প আরও অন্যরকম। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে যারা সেই কারাগারের অংশ হন সে সময়, তাদের মাঝে কেউ কেউ সুরের জালে আবদ্ধ হয়ে ব্যান্ডে যুক্ত হয়ে যান। ভালো কিছু করে সময় কাটানোর প্রচেষ্টায়। এভাবেই বেশ গান চলে কয়েকদিন বা কয়েক বছর। এরপর সাজা শেষ হয়ে গেলে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন, সেই শূন্য স্থানে সামান্য তাল হারায় কাকতাল।

ইউটিউবে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল জেল, কেরানীগঞ্জ’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে চর্কি নামের একটি গান রয়েছে। সেই গানের বর্ণনাতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। তখন আসামিদের মাঝ থেকে ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন— গোলাপ শাহীন (ভোকাল), আরমান (ভোকাল/গিটার), তরঙ্গ জোসেফ কস্তা (গিটার), প্রান্ত (ভোকাল/কি-বোর্ড), কাজল (ভোকাল/গিটার), মামুন (হারমনিয়াম), নাসির (তবলা), দেলোয়ার (বাঁশি/কি-বোর্ড), তারিফ (বাঁশি), জীবন (ভোকাল), পারভেজ (ড্রাম প্যাড/ভোকাল), জয়দেব (ভোকাল/ড্রাম প্যাড), সাদি (গিটার), রুমাত (গিটার/ভোকাল), আসিফ (গিটার/ভোকাল)।

২৬ মার্চের এক আয়োজনে অংশ নেওয়া পিন্টু ঘোষ এই ব্যান্ড দেখে চমকিত হন কারাগারে। কারাগারে বন্দী শিল্পীদের দর্শন তাকে মোহিত করে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কারাগারে বন্দী অনেকেরই জীবনাদর্শ অসাধারণ। তাদের মাঝে মেধাবী শিল্পীও আছেন।

অথচ ব্যান্ডটির সূচনা কারা কর্তৃপক্ষের হঠাৎ নেওয়া এব সিদ্ধান্তে। নেহায়েত সৃজনশীল চর্চার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ কয়েদিদের জন্য কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসেন। যার মধ্যে ছিল একটি অ্যাকোয়েস্টিক গিটার, এক জোড়া তবলা, একটি হারমোনিয়াম, একটি বাঁশি এবং একটি টাম্বুরিন। ২০২১ সাল নাগাদ কারা-শিল্পীদের সম্পদ হলো একটি অ্যাকোয়েস্টিক গিটারের জায়গায় চারটি অ্যাকোয়েস্টিক গিটার, তিনটি  হারমোনিয়াম, পাঁচটি বাঁশি, একটি বৈদ্যুতিক কি-বোর্ড ও একটি ড্রাম প্যাড। রেকর্ডিংয়ের জন্য একটি মাইকও পেলেন তারা। সঙ্গে একটি এমিপ্লিফায়ার ও এক জোড়া স্পিকার। সেই সাথে দারুণ একটা ব্যান্ড। যে ব্যান্ডের সদস্যরা কোনো না কোনো জীবনে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তেমনই একজন অন্তু। আসিফ ইকবাল অন্তু। যার প্রসঙ্গ একাধিকবার চলে আসতেই হবে কাকতালের গল্পে। ছয় বছরের জেলবাসের পর নির্দোষ প্রমাণের পর অন্তুর লাভের লাভ এই কাকতাল। যদিও অন্তর্জালে তার কেসের বর্ণনা বর্তমান, তবুও তার কথায় বারবার ফুটে উঠে ‘সেই অস্বস্তির দিনগুলো’।

অনেকেই বলেন, অন্তুর এই যাত্রার অনেকখানিই অঞ্জন দত্ত দ্বারা প্রভাবিত। সরেজমিনে দেখা যায়, মঞ্চে আসলে অন্তু গল্প করে করে গান করেন। যেমন- আজিমপুর কলোনিতে বড় হওয়া অন্তুর গান আছে শেকড় নিয়ে। সেই শেকড় তার প্রিয় আবাসের সাথে। সেই কষ্ট- অনুধাবন থেকে লেখা। কাকতালের বেশিরভাগ গান জীবনের অনুধাবন থেকে লেখা। এর পেছনে জেলজীবনের প্রভাবই মনে করেন ব্যান্ডের সদস্যরা।

অন্তুর ভাষায় কাকতাল নামটিও কাকতালীয়। খালি গলায় গান করতেন বলে নিজেকে কাকের সাথে তুলনা করেন অন্তু। খানিকটা কর্কশ। মাঝেমধ্যে একটু তালহীন দাপুটে। তবে তার মাঝেও তাল আছে কোনোভাবে, তাই ব্যান্ডের নাম হয়ে যায় কাকতাল। আপাতত কাকতালের নাম তালমিলে এই। আর জোড়াতালির সদস্যদের মাঝেও যারা বর্তমানে কারাহীন তারাই।

২০২১ সালের ২০ আগস্ট থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করা ব্যান্ডটির বর্তমান লাইনআপ নাজেম আনোয়ার, অ্যালেক্স জোভেন, ঋদ্ধ, অন্তু এবং ম্যানেজার জাভেদ। মূলত ‘কথা’ নির্ভর গান করতে পছন্দ করে এই ব্যান্ড। মিউজিকের ওপর ধারণা তেমন নেই বলেই জানান অন্তু। তাই বলেন, এ কারণেই আমাদের গান আসলে গল্প।

এই ব্যান্ডের একাধিক গান আলোচিত, যেমন,  ‘রক্ত গরম মাথা ঠাণ্ডা’। পরে ‘ভরসা আছে’ ও ‘শিক্ষার জবানবন্দী’ শিরোনামের গানও শ্রোতাপ্রিয়। এছাড়া অনেকের পছন্দের তালিকাতে ঢুকে পড়েছে ‘আবার দেখা হবে’, ‘গোলোকধাঁধা’, ‘সোডিয়াম’- এই গানগুলোও। সব মিলিয়ে কাকতালীয় কাকতালের সুরের যাত্রা চলছে অবিরাম স্রোতের মতো। এর সদস্যরাও সেই স্রোতে ভেসে যেতেই যেন লিখে যাচ্ছেন একের পর এক গান।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ