যখন আকাশে বেজে উঠলো সাইরেন। তেহরানের আকাশ তখনো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। মিসাইলের শব্দে কেঁপে উঠেছে পুরো সম্প্রচার ভবন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি স্টুডিওতে লাইভ চলছিলো সন্ধ্যার প্রধান সংবাদ। হঠাৎ বিস্ফোরণ। আলো নিভে যায়, কাঁচ ভেঙে পড়ে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া। সবার চোখ তখন ক্যামেরার দিকে।
অল্প সময়ের জন্য উঠে দাঁড়ালেও, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে পর্দায় ফিরলেন সাহার ইমামি। চোখে দৃঢ়তা, কণ্ঠে ঘোষণা- আমরা থামবো না। স্বাভাবিক স্বরে আবার পড়তে শুরু করেন খবর। এই দৃশ্য এখন শুধু ইরান নয়, পুরো বিশ্বের সামনে নারী সাহসিকতার এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে। মুহূর্তেই এই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে, আর সাহার ইমামি হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের এক জীবন্ত প্রতীক।

মিসাইলের শব্দে কেঁপে উঠেছে পুরো সম্প্রচার ভবন, তখনও সংবাদ পড়েন ইমামি, ছবি : এইচএলএন
কে এই সাহার ইমামি?
এক সময় তার স্বপ্ন ছিল খাবার নিয়ে কাজ করার। ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সাহার ইমামির ভাগ্য তাকে টেনে নেয় ক্যামেরার সামনে। ২০১০ সালে মিডিয়ায় পা রাখার পরই সাহার ইমামি হয়ে ওঠেন ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভির পরিচিত মুখ।
সংবাদ পাঠে তার কণ্ঠ ছিল দৃঢ়, ভঙ্গিমা ছিল শান্ত। এই নারী এখন শুধু একজন উপস্থাপিকা নন। একজন মা, একজন জীবনযোদ্ধা। তিনি যেমন সংসার সামলান, তেমনই সামলান জাতির খবর। আর আজ, তার নামটা মানুষ মনে রাখে সাহস, প্রতিজ্ঞা আর নির্ভীকতার প্রতীক হিসেবে।

মিসাইলের আঘাতের মধ্যেও স্বাভাবিক স্বরে পড়তে শুরু করেন খবর, ছবি ; নিউএইজ ইসলাম।
সাহস ও প্রতিক্রিয়ার প্রতীক
এটি কেবল একটি সম্প্রচার নয়, এটি একটি বার্তা। সাহার ইমামির এই অনন্য উপস্থিতি ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠেছে প্রশংসার ঝড়। অনেকেই বলছেন, তিনি এখন আর শুধু একজন সংবাদ উপস্থাপিকা নন। বরং হয়ে উঠেছেন একটি চলমান প্রতীক। যিনি প্রতিরোধ, দৃঢ়তা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করছেন।
তার সাহসিক মুহূর্তকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি থেকে শুরু করে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহদের সঙ্গে সাহার ইমামির ছবি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে নানান প্রচারমূলক বার্তায়। যেন তার মুখ হয়ে উঠেছে এক নতুন আদর্শের প্রতীক।
এ প্রসঙ্গে ইরানের নারী ও পরিবার বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট জাহরা বেহরামযাদে আযার মন্তব্য করেছেন, সাহার ইমামি ইরানের নারীদের সাহসের প্রতীক। তিনি শুধু একটি মুখই নন, বরং প্রতিরোধ এবং মানবিক দায়িত্ববোধের একটি দৃঢ় কণ্ঠস্বর।

ইরানজুড়ে এখন সাহার ইমামির নাম যেন সাহসিকতার প্রতীক, ছবি : এইচএলএন
ঘটনার নাটকীয়তা
আমি খবর পাঠ করছিলাম, হঠাৎ চারদিক কেঁপে উঠল। চোখের সামনে ধুলা, কাচ ভাঙছিল। তবুও আমি জানতাম, আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়- সাহার ইমামির এই উক্তি আর দৃশ্য যেন সিনেমার মতো। কিন্তু এটিই বাস্তবতা। ভয়, বিস্ময় আর দায়িত্ব এই তিনটি অনুভূতি একসাথে ধরা দিয়েছে সেই মুহূর্তে।
বাস্তবের এক সাহসিনী
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও দেখে অনেকেই লিখেছেন, একজন নারী তার জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই তো আসল নায়িকা। এই এক মুহূর্তে সাহার ইমামি হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের অনুপ্রেরণা।
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিধ্বনি
ইরানজুড়ে এখন সাহার ইমামির নাম যেন সাহসিকতার প্রতীক। তার ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বার্তা। তাকে বলা হচ্ছে মুক্তির কণ্ঠ। যিনি শুধু কথা বলেন না। নিজের কাজ দিয়ে দেখিয়ে দেন নারীর শক্তি ও দায়িত্ববোধ কীভাবে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে।

ইসরায়েলি হামলার মধ্যেও অনবরত সংবাদ পড়ে যান উপস্থাপক ইমামী, ছবি : প্রোপাকিস্তানি
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট
এই মুহূর্তটি ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। যেখানে যুদ্ধের বারুদের গন্ধ। সেখানে এক নারীর উপস্থিতি হয়ে উঠেছে একটি জাতির মনোবলের চিত্র।
সাহার ইমামির এই সাহসিকতা যেন গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে। স্টুডিও কেঁপে উঠলেও তার কণ্ঠ থেমে যায়নি। এই দৃশ্য ইরানজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় গর্বের উচ্ছ্বাস। অনেকেই বলছেন, এটি কেবল একজন সংবাদ উপস্থাপিকার দায়িত্ববোধ নয়, বরং একজন নারীর অটুট মনোবলের প্রকাশ।
নারীদের প্রতি সম্মান ও আস্থার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এই ঘটনার মাধ্যমে। সাহার ইমামি এখন শুধু খবর পাঠ করেন না। তিনি নারী সাহসিকতার প্রতীক। যিনি ভয় বা বিপদের মুখেও পেশাগত দায়িত্বে অটল থাকেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট-দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা এখনও অনেকেই করেন, সাহার ইমামির মতো সাহসী কণ্ঠগুলোই এই বিশ্বাসকে জাগিয়ে তোলে।
সূত্র : নিউ এজ ইসলাম