পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ‘ব্লু জোন’ নামে পরিচিত। এসব অঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাপানের ওকিনাওয়া, ইতালির সার্ডিনিয়া, গ্রীসের ইকারিয়া বা কোস্টারিকার নিকোয়া উপত্যকাকে এক সঙ্গে ‘ব্লু জোন’ বলে। তবে এই অঞ্চলগুলোর বাইরেও পৃথিবীতে আরও একটি বিস্ময়কর জায়গা আছে যেখানে মানুষেরা গড়ে শত বছরের বেশি বাঁচে। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হুঞ্জা উপত্যকা। আর এই জায়গাটি হলো পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের কারাকোরাম পর্বতমালার কোলে অবস্থিত এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। হুঞ্জায় তীব্র ঠান্ডা, দুর্গম পার্বত্য পথ আর নির্জনতা- এসব কিছু পৃথিবীর অন্য অনেক প্রান্ত থেকে এই অঞ্চলকে আলাদা করে তোলে। কিন্তু এখানের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এখানকার মানুষের দীর্ঘায়ু জীবন এবং রোগমুক্ত স্বাস্থ্য।
হুঞ্জা উপত্যকার মানুষেরা ৯০ থেকে ১২০ বছর বয়স পর্যন্ত সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকেন। এ অঞ্চলের নারী-পুরুষ উভয়েই বার্ধক্যের মাঝেও তরুণদের মতো প্রাণবন্ত ও সক্রিয় থাকেন। এমনকি এই অঞ্চলের মহিলাদের ৬০ বছর বয়সে মা হওয়ার কথাও শোনা যায়। আর ৯০ বছর বয়সেও পাহাড় বেয়ে হেঁটে চলেন অনায়াসে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে-কিভাবে এই অঞ্চলের মানুষেরা এতদিন বাঁচেন? রহস্যটা লুকিয়ে রয়েছে তাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।
প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস
হুঞ্জা উপত্যকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস তাদের দীর্ঘজীবনের অন্যতম মূল চাবিকাঠি। তারা মূলত উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেন। প্রতিদিনের খাদ্যে থাকে-কাঁচা বা আধা-সেদ্ধ সবজি, পাকা ও কাঁচা ফল। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে চেরি, আঙ্গুর, পিচ, আখরোট ও নানা ধরনের বাদাম জন্মায়। পাশাপাশি যব, গম, বাজরা উৎপাদিত হয়। তবে তাদের বিশেষ খাবার হলো অ্যাপ্রিকট ফল ও এর বীজ দিয়ে তৈরি তেল। এই ফল প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ, যা শরীরের প্রদাহ কমায় ও বয়সের ছাপ প্রতিহত করে।

অ্যাপ্রিকট ফল হুঞ্জা অঞ্চলের ডায়েটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্র্যাফি
পরিশ্রমী জীবনযাপন
হুঞ্জা উপত্যকার ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি। এখানকার মানুষদের প্রতিদিন বহু মাইল হাঁটতে হয়, খেত খামারে কাজ করতে হয়, পাহাড় বেয়ে চলাফেরা করতে হয়। এটা যেন তাদের নিত্যদিনের ব্যায়াম। তারা সাধারণত গড়পড়তা দিনে ১৫-২০ হাজার পদক্ষেপ হাঁটেন। মাটির কাজ, কাঠ কাটার কাজ করেন হাতে। হুঞ্জার অধিবাসীদের কাছে শরীরচর্চা কোনো আলাদা কাজ নয়, বরং জীবনের অংশ। এমন সক্রিয় জীবনশৈলী হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থুলতা থেকে দূরে রাখে। এছাড়া শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষমতা বাড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ হয়। পরিশ্রমী জীবনযাপন মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এবং মানসিক প্রশান্তি বা ভালো থাকার অনুভূতিও বাড়ায়।
মানসিক প্রশান্তি ও সামাজিক বন্ধন
হুঞ্জা সমাজে বৃদ্ধদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। পরিবারের সব বয়সী মানুষ একত্রে থাকেন। সমাজে বিভাজন কম, দ্বন্দ্ব কম। ফলে মানসিক চাপও তুলনামূলকভাবে কম। তারা হাসিখুশি থাকে এবং তারা ধ্যানচর্চায় অভ্যস্ত। হুঞ্জা জনপদের জীবন প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এটি মানসিক সুস্থতা বজায় রাখে। “মন ভালো তো শরীর ভালো”-এই দর্শন বাস্তবরূপ দেখা যায় হুঞ্জায়।

হুঞ্জা নদীর পানি আসে হিমবাহ গলিত বরফ থেকে, যা খনিজ সমৃদ্ধ এবং শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারি, ছবি: উইকিপিডিয়া
বিশুদ্ধ পরিবেশ ও পানি
হুঞ্জা নদীর পানি আসে হিমবাহ গলিত বরফ থেকে, যা খনিজ সমৃদ্ধ এবং অত্যন্ত বিশুদ্ধ। এই প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান শরীরের জন্য উপকারী। অনেক গবেষক মনে করেন, এই পানির অ্যালকালাইন বৈশিষ্ট্যই তাদের হজমক্ষমতা ও কোষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাদের জীবনধারা আধুনিক দূষণ থেকে দূরে, যেখানে নেই শিল্প বর্জ্য, দূষিত খাদ্য বা অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার।
চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধে বিশ্বাস
হুঞ্জা মানুষরা ওষুধে বিশ্বাসী নয়, বরং প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেন। তারা প্রচলিত হোমিওপ্যাথি ও হারবাল পদ্ধতি অনুসরণ করেন। কখনো গুরুতর অসুস্থ না হলে ডাক্তার দেখান না।
হুঞ্জা উপত্যকা আমাদের শেখায়-দীর্ঘায়ু কোনো গোপন ওষুধে নয়, বরং প্রাকৃতিক খাদ্য, সক্রিয় জীবন, মানসিক শান্তি আর ভারসাম্যপূর্ণ সমাজে লুকিয়ে আছে। তারা প্রমাণ করেছে-সতেজ জীবনযাপনই প্রকৃত দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি।