প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে সবাই সবার সাথে সবসময় যুক্ত, কিন্তু তবুও আমরা নিঃসঙ্গতায় ভুগি। ‘সবার মাঝে থেকেও আমি একা’– এই অনুভূতি আমাদের তাড়া করে। কিন্তু কেন?
বিচ্ছিন্নতা ও ডিজিটাল প্রযুক্তিগত যোগাযোগ
হার্ভার্ড গবেষক লরা মার্সিয়ানোর সম্প্রতি ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে একাকিত্বের সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি দেখিয়েছেন যে স্কুল থেকে বিরতির সময়ও কিশোর-কিশোরীরা, কথিত ডিজিটাল নেটিভস, সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি সত্ত্বেও একা একা দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছে। অর্থাৎ সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মানুষের সাথে বার্তা আদান প্রদান হলেও বাস্তব জীবনে ওই সময়টুকুতে তারা একাই থাকেন।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গবেষণাটির মূলভাব হলো, ডিজিটাল প্রযুক্তি অপরিসীম সুবিধা প্রদানের সাথে সাথে বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বের অনুভূতি দেয়। স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান আমাদের যোগাযোগের উপায়কে পরিবর্তিত করেছে। মুখোমুখি হয়ে কথোপকথনকে আমরা ধীরে ধীরে ডিজিটাল যোগাযোগ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলনা
একাকিত্বকে তীব্র করতে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রধান উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো সামাজিক তুলনা। ইনস্টাগ্রামের ফিডগুলো স্ক্রল করলে আপনি দেখবেন এমন সব ব্যক্তির প্রোফাইল আপনার সামনে আসছে যাদের জীবনযাপন অনেক ঈর্ষণীয়। আপনি কিছুক্ষণ স্ক্রল করার পর দেখবেন নিজের অগোছালো জীবন নিয়েই আপনি হীনমন্যতায় ভুগছেন।
অন্যদের জীবনের আদর্শিক সংস্করণগুলোর সাথে বাস্তবতার পার্থক্য অনেক। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাস্তবতার এই বানোয়াট সংস্করণ আপনার মধ্যে অস্বস্তিকর উপলব্ধি তৈরি করতে পারে, যা আপনাকে বিচ্ছিন্ন বোধ করাবে ও একাকিত্বে ভোগাবে।

প্রযুক্তি অপরিসীম সুবিধা প্রদানের সাথে সাথে বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বের অনুভূতি দেয়, ছবি: পিক্সেল ডটকম
কৃত্রিম সংযোগ
যদিও টেক্সট মেসেজিং যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, কিন্তু এটি প্রকৃত সংযোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। মৌখিক সংযোগের অভাব এবং টেক্সটিংয়ের প্রকৃতির কারণে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। এছাড়া বাচনভঙ্গির অনুপস্থিতি অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত করে ও যোগাযোগকে অসম্পূর্ণ রাখে।
বিঞ্জ-ওয়াচিং ট্র্যাপ
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, বিশেষ করে একটানা কোনো কিছু দেখা একাকিত্বের অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এটি স্বাভাবিক জীবনধারা ও ঘুমের ধরন ব্যাহত করতে পারে।
ব্রেকিং দ্য সাইকেল
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত।
সোশ্যাল মিডিয়ার সচেতন ব্যবহার
আপনি কোন ধরনের কন্টেন্ট দেখতে চান তা নিজে নির্বাচন করুন। ঈর্ষণীয় ও আত্ম-সন্দেহ প্ররোচিত করে এমন অ্যাকাউন্টগুলোর পরিবর্তে যেসব কন্টেন্ট আমাদের অনুপ্রাণিত করে এমন অ্যাকাউন্ট ফলো করতে হবে।
সামনাসামনি যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিন
পরিবার ও বন্ধুদের সাথে মুখোমুখি বসে গল্প করুন। এমন কাজ করুন যা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। যেমন- ক্লাবে যোগদান করা বা কোনো সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী হওয়া।

ডিজিটাল সময় খরচের টাইমার নিজেই সেট করুন, ছবি: পিক্সেল ডটকম
স্ক্রিন টাইম সেট করুন
আপনার ডিজিটাল সময় খরচের টাইমার নিজেই সেট করুন। সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিং এবং স্ট্রিমিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় ও স্লট বরাদ্দ রাখার অভ্যাস করুন। এতে আপনি একটু আরাম করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের যেমন সময় পাবেন তেমনি প্রয়জনীয় কাজ করার সময় ক্লান্তি অনুভব করবেন না।
ডিজিটাল ডিটক্স অনুশীলন করুন
যত পারবেন বাস্তব পৃথিবী উপভোগের চেষ্টা করুন। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এলগরিদম এমনভাবে সেট করা যাতে আপনি সারাদিন বিরতিহীনভাবে স্ক্রল করতে থাকেন এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাই এই ফাঁদে পা না দিয়ে প্রযুক্তি থেকে নিয়মিত বিরতি নিন।
ভিডিও চ্যাটকে প্রাধান্য দিন
যখনই সম্ভব টেক্সট ম্যাসেজের জায়গায় ফোনকল বা ভিডিও চ্যাট বেছে নিন। কারণ কথা বলা, দেখা ও মুখের অঙ্গভঙ্গি যোগাযোগকে আরও প্রাণবন্ত ও অর্থপূর্ণ করে।
প্রযুক্তির যেমন জীবনকে অনেক সহজ করেছে, কিছু ক্ষেত্রে সহজাত কথোপকথনের মতো কাজগুলোকে আরও জটিল করেছে। প্রযুক্তির ত্রুটিগুলো বুঝে তা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আমরা প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি।
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস