ফুটবলে সাফল্য আর ব্যর্থতায় মোড়ানো ছিল ২০২৪ সাল। সারা বছর সবার চোখ ছিল আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসির দল ইন্টার মায়ামি এবং সৌদি আরবে খেলা রোনালদোর ওপর। শুধু খেলোয়াড় নয়, দল হিসেবেও কেমন করেছে তার খোঁজ-খবর রেখেছে দর্শকরা। শেষ বেলায় এসে জীবনের খাতায় যেমন চলছে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব-নিকেশ, তেমনি ক্রীড়াঙ্গনেও আছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা গল্প।
এ বছর স্প্যানিশ ফুটবলের সাফল্য এমনই আকাশছোঁয়া যে, পেছন ফিরে তাকালে দলটির সমর্থকরা হয়তো বিস্মিত হবে। বিশ্ব ফুটবলের আরেক কোণায়, সাফল্যের মাপকাঠিতে আর্জেন্টাইনদের অর্জন অতটা পাহাড়সম না হলেও, তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই পারে তারা। ফুটবলের সবুজ আঙিনায় ২০২৪ জন্ম দিয়েছে কতশত ঘটনা, আনন্দ-বেদনার মুহূর্ত।
স্প্যানিশ ফুটবলের সোনালী যুগ কোনটি? উত্তর খুঁজতে গেলে শুরুতেই হয়তো মনের কোণে ভেসে উঠবে শাভি-ইনিয়েস্তা-কাসিয়াসদের সেই সর্বজয়ী দলের সেই সময়। তবে, আরেকটু নিবিড়ভাবে ভাবলে মনের পর্দায় উঁকি মারবে বর্তমান। সত্যিই তাই! এই বছরেই দেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে স্পেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ক্লাব ফুটবল, দলগত থেকে ব্যক্তিগত- সবখানে স্প্যানিশদের জয়জয়কার। এসবের মাঝে এবার অলিম্পিক ফুটবলেও সোনার হাসি হেসেছে স্প্যানিয়ার্ডরা। সাফল্যের প্রতিটি পাতায় দিনশেষে কেবল জয়ের গল্পই লেখেনি তারা, আধিপত্য ছড়িয়ে কোথাও নিজেদের পুরোনো দাপটকে পোক্ত করেছে আরও, আবার কোথাও লিখেছে নতুনের জয়গান।
বার্সেলোনার ওই সাফল্যগাঁথায় বিশ্ব ফুটবলে আরেক জায়গায়ও নিজেদের আধিপত্য পোক্ত হয় স্প্যানিশ ফুটবলের। ওই আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত স্পেনের তারকা মিডফিল্ডার আইতানা বনমাতি পরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেয় বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন দ’র।
বনমাতিদের ওই সাফল্যের পর সপ্তাহ ঘুরতেই ফুটবলের আঙিনায় নতুন গল্প রচনা করে রেয়াল মাদ্রিদ। স্পেনের তো বটেই, ইউরোপেরই সেরা ক্লাব তারা। জুনের প্রথম দিনে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বসে পুরুষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতে, নকআউট পর্বেও সব লেগে অপরাজিত থেকে, ফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতাটিতে রেকর্ড পঞ্চদশবারের মতো শিরোপা উল্লাস করে মাদ্রিদের দলটি। ইউরো-২০২৪ এ ছয় ম্যাচের সবগুলো জিতে উঁচিয়ে ধরে তারা ট্রফি।
গত মৌসুম জুড়েই চোটসমস্যা খুব ভুগিয়েছে মাদ্রিদের ক্লাবটিকে। সমস্যা পিছু ছাড়েনি তাদের এই মৌসুমেও। বলা যায়, কোনো ম্যাচেই সেরা দল মাঠে নামাতে পারেনি তারা। এরপর অগাস্টে উয়েফা সুপার কাপ এবং ডিসেম্বরে এসে ফিফা কন্টিনেন্টাল কাপ উঁচিয়ে ধরেন ভিনিসিউস-এমবাপেরা।

কোপার শিরোপা জেতার পর উল্লাসে মাতে আর্জেন্টিনা জাতীয় দল, ছবি: স্কাই নিউজ
দীর্ঘ খরা কাটিয়ে তর্কসাপেক্ষে নিজেদের ইতিহাসের সেরা সময় কাটাচ্ছে আর্জেন্টিনা। লিওনেল স্কালোনির দুর্দান্ত কৌশল আর মাঠে লিওনেল মেসির অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের মিশেলে আরেকটি সোনা ফলানো বছর কাটিয়েছে তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। কোপা আমেরিকার শিরোপা ধরে রাখার পাশপাশি ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের টেবিলে শীর্ষে আছে আর্জেন্টিনা। আরেকটি বছর তারা শেষ করেছে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থেকে। ফুটবল ইতিহাসের কেবল দ্বিতীয় দল হিসেবে টানা জিতেছে মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা-বিশ্বকাপ-মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার শিরোপা।
বিপরীতে, লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে আরেকটি হতাশার আসর কেটেছে ব্রাজিলের। কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়ে হয়েছে ষষ্ঠ। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ১২ ম্যাচে ৫ জয় আর তিন ড্রয়ে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে আছে পাঁচে। এরই মধ্যে হেরেছে চার ম্যাচ।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে এবং দলের সবগুলো সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়ার সম্ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ভিনিসিউস জুনিয়র। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর, ব্যালন দ’রের লড়াইয়ে তাকে পেছনে ফেলে পুরস্কারটি জিতে নেন রদ্রি।

ভিনিসিউস জুনিয়র
বছরের শুরুটা ছিল বিশ্ব ফুটবলের জন্য বেদনার। ভক্ত সমর্থকদের কাঁদিয়ে দুই দিনের মধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন দুই কিংবদন্তি মারিও জাগালো ও ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার।
১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন জাগালো। ফাইনালে নিজে গোল করার পাশাপাশি বানিয়ে দেন পেলের গোল। পরের বিশ্বকাপে শিরোপা ধরে রাখা দলেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন এই লেফট উইঙ্গার। এরপর, ১৯৭০ সালে ডাগআউটে থেকে ব্রাজিলকে আরেকটি শিরোপা জিতিয়ে রচনা করেন ফুটবলার ও কোচ, দুই ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয়ের প্রথম ইতিহাস।