Home অপরাধ ফ্রয়েড, মার্ক্স ও কাফকা: কেন সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হয়

ফ্রয়েড, মার্ক্স ও কাফকা: কেন সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হয়

সুপ্রভা জুঁই
৬৪ views

আপনি কি টিম মামুন, নাকি টিম লাইলা? পলাশ সাহার মৃত্যুর পিছনে বউটার দোষ, নাকি শাশুড়িটার? 

সম্প্রতি মমতাজকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাইকোর্টে। মিডিয়ার মানুষ ও ক্যামেরার ধাক্কায় একগাদা পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এ দৃশ্য নতুন নয়। কিন্তু কেন একজন মানুষকে অপদস্থ হতে দেখলে আমাদের এত ভালো লাগে? সেই মানুষ যে অপরাধের সাথে জড়িত সেটা অনৈতিক মনে হলে আমাদের খারাপ লাগে। আর নৈতিক মনে হলে খুবই পুলক হয়। আমরা হাসাহাসি করি, মিমস বানাই, শেয়ারও দিয়ে থাকি। 

ভাইরাল টিকটকারদের ছাপড়ি, নিচুশ্রেণির মনে করা হয়। তাহলে তাদের ভাইরাল করছে কারা? আম-মানুষের রুচিকে খারাপ বলতে চাচ্ছেন? আপনার রিলসের এলগরিদম তার মতো করে আপনার চরিত্র গঠন করছে যা আপনি টেরও পাচ্ছেন না। অর্থাৎ, আপনি যা দেখতে চান তাইই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিকল্পিতভাবে আপনাকে দিয়ে থাকে। এভাবে আপনার অলক্ষ্যে একটি দেশের ক্ষমতা বদলানো থেকে শুরু করে ধনীদের আরও ধনী করতে নিজের পকেট ফাঁকা করে ফেলছেন আপনি নিজেই। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে এলগরিদমের বানানো একটা জগতে আমরা বাস করি যেটা আমাদের কাছে সত্যি মনে হয়। আমরা নানান কিছু অনলাইনে অর্ডার করি, কিন্তু আমরাই সবথেকে বড় পণ্য এটা আমরা কবে বুঝবো?  

কেন সহিংসতা আর যৌনতা হাত ধরে হাঁটে? কেন ভারতে জনপ্রিয় সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’, যেখানে সত্যিকারের অপরাধের ঘটনাকে নাটক বানিয়ে দেখানো হয়। পরকিয়া থেকে খুন ইত্যাদি গল্পে ঠাঁসা সেই সিরিয়াল। কিংবা বাংলাদেশের ‘তালাশ’ এর মতো শো গুলো কেন এত জনপ্রিয়? কেন ইদানিং কিছু কন্টেন্ট ক্রিয়েটর জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন যারা সেরা সেরা অপরাধের কেসগুলোকে নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ ভিডিও বানান? 

আমরা মুখে বলছি শান্তি চাই। অথচ শান্তির চাইতে অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে আমরা আকর্ষিত। এনিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। ফ্রয়েড, মার্ক্স, কাফকা ও আধুনিক মিডিয়া তত্ত্বগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। 

ফ্রয়েডিয়ান ব্যাখ্যা  

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মন তিনটি স্তরে বিভক্ত: ইড (Id), ইগো (Ego) এবং সুপারইগো (Superego)। ফ্রয়েড বলেন, ‘ইড’ হল আমাদের আদিম, অবদমনহীন বাসনার কেন্দ্র। এটি যৌনতা, আগ্রাসন, খাদ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি মৌলিক তাড়নার দ্বারা চালিত। সহিংসতার দৃশ্য অর্থাৎ নির্মমতা, রক্তপাত, শারীরিক শক্তির প্রকাশ ইত্যাদি হলো ইডের আদিম বাসনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অনেক মানুষ এই সব সহিংস ভিডিও দেখে শিহরিত হয়, কারণ এগুলো অবচেতনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একপ্রকার নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে।

‘ইগো’ বাস্তবতা যাচাই করে। যদিও মানুষ বাস্তব জীবনে সহিংসতা চর্চা করে না, কিন্তু ভার্চুয়াল মাধ্যমে (যেমন ভিডিও) সহিংসতা দেখার মাধ্যমে তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে এই বাসনাকে উপভোগ করতে পারে। এটি এক ধরনের “displacement” বা প্রতিস্থাপন, যেখানে বাস্তব সহিংসতার জায়গায় ভিডিও দেখার মাধ্যমে সেই বাসনার কিছু অংশ পূরণ হয়।

‘সুপারইগো’ হল আমাদের নৈতিকতা ও আদর্শের কেন্দ্র। সহিংসতা দেখার পর অনেকের মনে অপরাধবোধ জাগে, আবার কেউ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভিডিও শেয়ার করে, যেন তারা “বিচার চাই” বলে একটি উচ্চতর অবস্থান গ্রহণ করছে। যদিও ফ্রয়েডের মতে নৈতিকতা অনেক সময় ইডের বাসনাকে ঢাকতে একটি মুখোশের মতো কাজ করে।

মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা  

সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হয় কারণ এটি ক্ষমতাবান ও শোষিতের সম্পর্ককে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। পুঁজিবাদী সমাজে যাদের চাপে রাখা হয়, তাদের উপর সহিংসতা দেখিয়ে ক্ষমতাবানরা আধিপত্য কায়েম রাখে। কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো সরাসরি। এসব ভিডিও অনেক সময় শোষিত শ্রেণির দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব প্রদর্শন করে, যাতে সমাজে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে ‘অনুগত নাগরিক’ তৈরি করা যায়। আবার অনেক সময় শোষণের প্রকৃতি উন্মোচনের মাধ্যম হিসেবেও ভিডিওগুলো শেয়ার হয়। যেমন: পুলিশি বর্বরতা বা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ভিডিও, যেগুলো জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু পুঁজিবাদ এটাকেও পণ্য করে ফেলে। সহিংসতা তাই এখন পপ কালচারের অংশ যা বিজ্ঞাপন এবং আয়ের হাতিয়ার। 

e copy 1

কিছু রিলস দেখে আপনি তৃপ্তি পাবেন এত সহজে নিশ্চয় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না

কাফকাসয়ীয় ব্যাখ্যা

ফ্রানৎস কাফকা-র সাহিত্য একধরনের অস্তিত্বগত দুঃস্বপ্ন ও অজানা কর্তৃত্বের আতঙ্ককে তুলে ধরে। এখানে মানুষ এক অদৃশ্য ব্যবস্থার শিকার, যার কোনো ব্যাখ্যা বা ন্যায়বিচার নেই। সহিংসতার ভিডিও আমাদের নির্বিকার বানিয়ে তোলে যার কোনো স্পষ্ট যুক্তি নেই, বিচার নেই। এটি কাফকার “Trial” বা “The Castle”-এর মতই। দর্শক নিজে বুঝে, বা না বুঝে এই অর্থহীন ও যান্ত্রিক সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়। কারণ সমাজ নিজেই এমন এক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে যেখানে নিরাপত্তাহীনতা, অজ্ঞতা ও নিঃসঙ্গতা রোজকার মামলা। সহিংসতা এখানে এক ধরনের নির্বিকার রুটিন বা ‘absurd spectacle’ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সহিংসতা দেখেও কিছু অনুভব না করাটা নতুন মানসিকতা হয়ে উঠছে। কাফকার দৃষ্টিতে, মানুষ এখন সহিংসতা দেখে কারণ সেটিই তার বাস্তবতার সবচেয়ে কাছের প্রতিচ্ছবি। সে যে অর্থহীন সমাজব্যবস্থার অংশীদার সেটারই প্রতিফলন এখানে দেখা যায়।

আধুনিক মিডিয়া তত্ত্ব 

আধুনিক মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাইরাল কনটেন্ট মানেই যা “মনোযোগ চুরি” করতে পারে। Attention Economy, এর এই নয়া সময়ে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে মানুষের মনোযোগ যত বেশি সম্ভব আটকে রাখা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম যেসব কনটেন্টে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হয় (লাইক, শেয়ার, কমেন্ট), তা বেশি দেখায়। সহিংস ভিডিও এইসব ইমোশন খুব দ্রুত জাগায়, তাই তারা বেশি “বুস্ট” পায়। ক্রমাগত সহিংসতা দেখলে মানুষের মন ভোঁতা হয়ে যায়, যা ভিডিওগুলোকে আরো চরম হতে বাধ্য করে যাতে আবার মনোযোগ পাওয়া যায়।

তাহলে প্রিয় পাঠক, কি দেখছেন তার উপরে নির্ভর করছে আপনি কেমন সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখছেন, আপনি ন্যায়বিচার পাবেন কিনা, আপনি স্বৈরশাসক তৈরি করছেন কিনা, আপনার ব্যক্তি মানুষ হিসেবে সুকুমার বৃত্তিগুলো জাগ্রত হচ্ছে কিনা যার দরুন আপনি এই বিশ্বের প্রাণীকূলের জন্য সত্যি কোনো অবদান রাখতে পারবেন। কিছু রিলস দেখে আপনি তৃপ্তি পাবেন এত সহজে নিশ্চয় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আমাদের যে মরমি দর্শন সেখানে মানুষের জন্য বারবার সৃষ্টিশীল নানান কাজে অংশগ্রহণের কথা বলা হয় যাতে আমাদের অদম্য এনার্জিকে মানবকল্যানে কাজে লাগাতে পারি। নতুবা সেই এনার্জি বিপদজনক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হলে তা পারমাণবিক বোমার চাইতেও ভয়ানক হয়ে উঠবে। 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ