গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের দাম হু হু করে বেড়েই চলছে। দাম বাড়ানোর পেছনে কার হাত রয়েছে, কেনই বা ইলিশের দাম এতো উচ্চতায় গিয়ে ঠেকেছে। চড়া দামে বিক্রি হওয়া ইলিশের কত টাকা জেলেরা পান? ইলিশ বিক্রিতে লাভবান হচ্ছেন কারা? নদীতে কেন আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রেতা সাধারণের কাছে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠকদের স্পষ্ট করা যাক। দেখা যায়, দশ দিন আগে একটি ট্রলারে ১০ জন জেলে ও একজন মাঝি নদীর গভীরে যান মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে। তারা ১৫ হাজার টাকার চাল-ডালসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনেন। আর ডিজেল কেনেন ৪০ হাজার টাকার। মোট ৫৫ হাজার টাকার খরচ হয় । ধরা যাক জেলেরা মাছ পেল দেড় লাখ টাকার। অর্থাৎ ৯৫ হাজার টাকা লাভ হয়।
এই লাভের অর্ধেক ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা পান ট্রলার মালিক। বাকি ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা ১২ ভাগে ভাগ হয়। দুই ভাগ ট্রলারের মাঝির, বাকি ১০ ভাগ ১০ জন জেলের। প্রতিভাগে পড়ে তিন হাজার ৬৫৩ টাকা করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল নদীতে মাছ শিকার করে একজন জেলে দৈনিক হাজিরা পেয়েছেন মাত্র সাড়ে তিনশত টাকার মতো।
হাত বদলের হিড়িক:
ইলিশ ঘাট থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রাহকদের হাতে পৌঁছাতে ৪ থেকে ৫ বার হাত বদল হয়। মহাজনের আড়ৎ থেকে পাইকারের মাধ্যমে পাঠানো হয় ঢাকা, বরিশাল, চাঁদপুরের মোকামে। সেখান থেকে বড় ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে যায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। হাত বদলের প্রতিটি স্তরেই মূল্য সংযোজন হয়ে কেজিতে দাম বেড়ে যায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া যুক্ত হয় সংরক্ষণের বরফ, প্যাকেজিং ও পরিবহণ খরচ। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নদীগুলোতে ইলিশ কমে যাওয়া ও জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যের প্রভাব।
চোরাই পথে পাচার:
রফতানি বন্ধ থাকলেও সারা বছরই চোরাই পথে ভারতে ইলিশ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সাগরের সুন্দরবন, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিকরগাছা, বেনাপোল, ঝিনাইদহ, কালিগঞ্জ, মেহেরেপুর ও কুষ্টিয়ার গ্রাগপুর দিয়ে ভারতে ইলিশ পাচার হয় বলে জানা গেছে।
সিন্ডিকেট যখন ব্যবসায়ীক সম্পর্ক:
পাইকাররা জানান, মোকাম থেকে টাকা এনে তারা ব্যবসা করেন। তাই নির্দিষ্ট মহাজনের বাইরে ইলিশ বেচাকেনা করতে পারেন না। লোকসান হলেও মহাজনের আড়তে মাছ দিতে হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলেও লাভের পরিমাণ বেশি হয়। আর চাহিদা কমে গেলেই গুনতে হয় লোকসান। তবে ঘাট থেকে মোকাম পর্যন্ত সিন্ডিকেট থাকলেও এটাকে ব্যবসায়ী সম্পর্ক হিসাবে দেখছেন তারা। রাজধানীর পাইকারি বাজার থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত সবাই একই সিন্ডিকেটের সদস্য।

বরফে সংরক্ষিত রুপালি ইলিশ। ছবি: সংগৃহীত
আড়ৎ মালিকদের মন্তব্য:
আড়ৎ মালিকরা জানান, তাদের কাছ থেকে জেলেরা টাকা নিয়ে জাল-নৌকা প্রস্তুত করেন। এ কারণে জেলেদের ধরা মাছ থেকে তারা ১০ ভাগ কমিশন নিয়ে থাকেন। আর ঘাটগুলোতে ওপেন নিলামের মাধ্যমে মাছ বেচাকেনা হওয়ায় জেলেরা দাম কম পাওয়ার আশঙ্কা নেই বলে দাবি তাদের। বর্তমানে ইলিশ খুব আসে না। যার কারণে দাম অনেক বেশি। তাই ভারতে রপ্তানি এক রকম বন্ধ রয়েছে। কারণ যে দামে কিনতে হয়, ভারতে সেই দাম পাওয়া যায় না। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অনেকেই লসে রয়েছে। শুধুমাত্র লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে না পাঠালেই নয়, এমন পরিমাণ মাছ পাঠাচ্ছে।”
ক্যাব এর মন্তব্য:
ইলিশ বেচাকেনায় কোনো নিয়মনীতি ও সংশ্লিষ্টদের তদারকি না থাকায় সিন্ডিকেট দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) । এ সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য অধিকারবঞ্চিত হচ্ছেন জেলেরা, ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে অধিক দাম। ইলিশের দাম নির্ধারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতাই নেই মৎস্য বিভাগের। এমনকি জেলেরাও মাছের দাম নির্ধারণ করতে পারেন না। ইলিশ শিকার ও বাজারজাতে তদারকি সংস্থার দুর্বলতার কারণেই দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে সিন্ডিকেট।
ইলিশের হালচাল:
বাজারে বর্তমানে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজিদরে। আর আধা কেজি ওজনের ইলিশের কেজি হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। ২০০ থেকে আড়াইশ গ্রাম ওজনের জাটকা ইলিশের কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতো উচ্চমূল্যের রূপালী ইলিশ কিনে অনায়াসে মুখে তোলার সামর্থ্য নেই অনেকেরই। নিম্মবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে ইলিশের দাম।
আশার বাণী:
সিন্ডিকেট ভেঙে ইলিশের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করার কথা জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারাা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ চলছে। শিগগিরই যার সুফল ভোক্তা ও জেলেরা পাবেন।
ক্রেতার কমতি নেই:
ইলিশের বর্তমান উচ্চমূল্যের জন্য জেলে, মহাজন, বেপারী, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা নদীতে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়াকে দুষছেন। গত ৪/৫ বছর ধরে নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। কিন্তু ঘাটে কিংবা বাজারে ইলিশের অনেক চাহিদা থাকায় দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বাজারে মাছের চাহিদা আছে। কিন্তু সে হিসেবে নদীতে বা ঘাটে মাছ নেই। তাই সংকট থাকলেও দাম যতই হোক, ক্রেতা পাওয়া যায়।
নদীতে ইলিশ কেন কমেছে?
২০০০ সালের আগে জেলেরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে উপকূলের খুব কাছে অবস্থান নিয়ে মাছ শিকারে যেত। কিন্তু দুই দশকের ব্যবধানে নদীতে মাছ কমতে শুরু করে। উপকূলের কাছাকাছি নদীতে অনেকটা মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। এবার জেলেরা ডিঙি নৌকা বাদ দিয়ে ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা বা ট্রলার নিয়ে গভীর নদীতে মাছ শিকারে নেমে পড়েছেন। আবার কোনো কোনো জেলে বেশি মাছের আশায় গভীর সমুদ্রেও চলে যান। কিন্তু গভীর নদীতেও এখন আর মাছ পাওয়া যায় না।
ইলিশ গভীর জলের মাছ। পানির পরিমাণ যত বেশি হবে, ইলিশের বিচরণ তত বাড়বে। কিন্তু নদীর গভীরতা দিন দিন কমছে। ফলে মাছের বিচরণ কমে গেছে। সমুদ্রে ইলিশ থাকলেও সে মাছ এখন আর নদীতে আসতে পারে না। এর কারণ হিসেবে তারা নদীর গভীরতা বা নাব্য সংকটকে দায়ী করছেন মৎস্যজীবী, মৎস্য কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাহাড়ি উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সঙ্গে প্রতিনিয়ত পলিমাটি এসে নদী ভরাট হচ্ছে। আবার উপকূলীয় এলাকা ভাঙনের ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলেও নদীর গভীরতা কমছে। নৌযানের কারণেও দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। এসব কারণে গভীর সমুদ্র থেকে এখন আর নদীতে মাছ আসতে পারছে না।