Home বাণিজ্য কয়েকটি ব্যাংকে নগদ টাকা উত্তোলনে ভোগান্তি

কয়েকটি ব্যাংকে নগদ টাকা উত্তোলনে ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
১০৩ views

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে চেক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেও চাহিদামতো টাকা তুলতে পারছেন না গ্রাহকরা। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। অ্যাপ ও অনলাইনে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সীমিত করে রাখা এসব ব্যাংকে লেনদেন করতে না পেরে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করেও গ্রাহকরা কোনো সমাধান পাননি। সব মিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা।

কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো নজিরবিহীন তারল্য সংকটে পড়েছে। ব্যাংক খাতে গত ১৫ বছর ধরে চলা লুটপাট ও বিশৃঙ্খলার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি অনেক গ্রাহক হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়ার কারণেও সংকটে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহকদের ধীরে ধীরে কম পরিমাণে অর্থ উত্তোলন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বেশি তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে গ্রাহকরা চাহিদামতো টাকা না পেয়ে মুখ কালো করে ফিরছেন।

আরও কয়েকটি ব্যাংকে অনেক গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির শিকার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। যেমন ব্যাংকগুলোতে টাকা তুলতে গেলে তাদের বলা হয়েছে, যার যে শাখায় অ্যাকাউন্ট, তাকে সেই শাখায় গিয়ে টাকা তুলতে হবে।

মূলত এসব ব্যাংকের কাছে নগদ টাকা না থাকায় গ্রাহকদের এই ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, যা স্বীকার করেছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও। অবশ্য তারা বলছেন, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাধারণ আমানত, মেয়াদি আমানত, বেতনের টাকা, সঞ্চয়– কোনো ধরনের হিসাব থেকেই চাহিদামতো টাকা তুলতে অথবা অনলাইনে অন্য ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়েও স্থানান্তর করতে পারেছেন না  গ্রাহকরা।

কয়েক সপ্তাহজুড়ে ব্যাংকগুলোর এমন কার্যকলাপে হতাশা ও আস্থাহীনতায় ভুগছেন গ্রাহকরা, যারা তাদের জমানো টাকার নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কায় পড়েছেন। 

এমন একজন ভুক্তভোগী বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুর রহমান। গত সপ্তাহে ঢাকার মতিঝিলের দিলকুশায় ইউনিয়ন ব্যাংকের  শাখায় নিজের একাউন্ট থেকে চেক দিয়ে এক লাখ টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। ক্যাশ কাউন্টার থেকে তাকে বলা হয়, ২০ হাজার টাকার বেশি দিতে পারবে না।

কেন দিতে পারবেন না, সাইদুরের সেই প্রশ্নের জবাবে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে বলেন, নগদ টাকার সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তারা টাকা পাচ্ছেন না। তাই শাখার হাতে যে পরিমাণ টাকা আছে, তা-ই সবাইকে একটু একটু করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। হতাশ সাইদুর বাধ্য হয়ে ২০ হাজার টাকা নিয়েই ফিরে আসেন।

তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার টাকা আমিই তুলতে পারছি না, এর চেয়ে হতাশার আর কিছু হয়! ব্যাংকের যে এই অবস্থা, অথবা কোনো সমস্যা, তা তো আগে থেকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়নি। পুরো অবস্থাটা অদ্ভুত লেগেছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবি) বাসাবো শাখা থেকে গত রোববার ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছেন অভিবাসী শ্রমিক আলাউদ্দিন। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে তার বাবার চিকিৎসাধীন। তার জন্য টাকা তুলতে আলাউদ্দিনকে ব্যাংক থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা অফার করা হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি টাকার অংক বাড়ানোর জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তবে তারা তীব্র তারল্য সংকটের কথা উল্লেখ করে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন।

এরপর আলাউদ্দিনকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল। তিনি  বলেন, আমি তাদের বলেছিলাম, এ টাকা আমার বাবার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু তারা বলেছেন, ব্যাংক নগদ প্রবাহের সংকট রয়েছে। এর বেশি দিতে পারবেন না। এই খরচ আমি কীভাবে মেটাব?

ন্যাশনাল ব্যাংক ফেনীর সোনাগাজী শাখায়  আজ (মঙ্গলবার) সকাল ১১টায় জনৈক গ্রাহক  মুমুর্ষু পিতার চিকিৎসার জন্য ব্যাংক থেকে  ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন । ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকে গ্রাহকদেরকে দেয়ার মতো টাকা নেই। তারা টাকা পরিশোধ করতে অপারগ।

Bank

রাজধানীর মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের শাখায় টাকা তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা । ছবি: বিবিসি

এগুলো  বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। দেশজুড়ে একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনীতে এফএসআইবি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহকদের প্রত্যেকবার লেনদেনে মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা অফার করার পরে অনেক গ্রাহক হতাশ হয়ে চলে গেছেন।

এফএসআইবির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মান্নান সংকটের  বিষয়টি নিশ্চিত করলেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘জরুরি চাহিদা মেটাতে চলতি সপ্তাহে ৩০০ কোটি টাকা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এছাড়া ঘাটতি মেটাতে এফএসআইবি তাদের বিনিয়োগ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।’

তিনি বলেন, স্বল্প মেয়াদে তারল্য নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তঃব্যাংক ঋণের নিশ্চয়তা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সহসভাপতি মান্নান বলেন, ব্যাংকিং খাতের এটি একটি নিয়মিত ব্যবস্থা, যা দেশে বিগত সরকারের আমলে নানা অপব্যবহারের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।

ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে আর্থিক দুরবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীনতাকে দায়ী করেছেন। সবসময় ন্যাশনাল ব্যাংকের সুনাম ছিল, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণে এটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এখন পদক্ষেপ নেওয়া এবং তারল্য ঘাটতি ঠিক করা তাদের দায়িত্ব বলে জানান তিনি।

এস আলম ও সিকদার গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলো ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকগুলো পঙ্গু হয়ে পড়ে। এখন আমানতকারীরা ভুগছেন। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে এসব ব্যক্তির অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ফলে ব্যাংকগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে।

দেশের ৬১টি ব্যাংকের ১১ হাজারের বেশি শাখার অনেকগুলোই নগদ অর্থের তীব্র সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বাজারে অর্থপ্রবাহ কিছুটা কমেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ছাত্র বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাধ্যমে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে বিষয়টিকে আরও ঘনীভূত হয়েছে। সে সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, এর ফলে নগদ স্থানান্তরে ব্যাপক বিলম্ব এবং লেনদেনে জট তৈরি হয়।

ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাংক খাতের সংস্কারের কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ‘দুর্বল’ ব্যাংকগুলোর মালিকায় ব্যাপক অনিয়ম, পরিচালনায় সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হওয়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর সক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকেছে, যা নিয়ে দীর্ঘদিন করে কথা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের পছন্দের গভর্নরকে অপসারণ করে সেখানে বসানো হয় অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি ব্যাংক খাতে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, তবে এর জন্য সময়ও চেয়েছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতা বা শঙ্কা থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে ব্যাংকগুলো যেন খালি করে না ফেলে এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু ‘কৌশলগত’ কারণে গ্রাহকের দিনপ্রতি সর্বোচ্চ টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ দেশের ব্যাংকিং খাত সচল রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ