চা—পানীয় ,আবেগ নাকি নিছক অভ্যাস? সকাল কিংবা বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে বাঙালির দিন শুরু হয় না। চায়ের সাথে বাঙালির সম্পর্ক নিবিড়।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষের জীবনে চা যেন এক এক ধরনের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। জাপানের আনুষ্ঠানিক চা-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্রিটেনের বিকেলের ‘টি-টাইম’ বা মরক্কোর মিন্ট-চা—প্রতিটি দেশেই চা তাদের নিজস্ব রীতিনীতি আর ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে। আজ আমরা চলি এক কাপ চা হাতে, বিশ্বভ্রমণে।
জাপান: চা যেখানে ধ্যান

টি সেরেমোনির প্রস্তুতি নিচ্ছেন একজন টি-মাস্টার, ছবি: জাপান ওয়ান্ডার ট্রাভেল ব্লগ
জাপানে চা কেবল পানীয় নয়—এটি একধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। “চা-নো-ইউ” বা চা অনুষ্ঠান সেখানে বিশুদ্ধতা, শ্রদ্ধা, শান্তি ও আন্তরিকতার প্রতীক। বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত মাচা (গুঁড়ো সবুজ চা) বিশেষ পদ্ধতিতে পরিবেশন করা হয়। প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি নীরবতা—সবকিছুতেই থাকে শিল্প আর ভাবনার ছোঁয়া।
ইংল্যান্ড: বিকেলের চা আর পরিপাটি সমাজ

ইংলিশ চায়ের বিকালের আয়োজনে থাকে নানা ধরনের মিষ্টি ডেজার্ট আইটেম, ছবি: দ্যা রয়্যাল হাউজগার্ডস হোটেল
“Afternoon Tea”—ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত, বিকেলের এই চা-পানের ঐতিহ্য বহু যুগের পুরোনো। সাধারণত এক কাপ দুধ-চা, সঙ্গে স্কোন, জ্যাম, কেক বা স্যান্ডউইচ—এ এক পরিপাটি, সুশৃঙ্খল আয়োজন। সামাজিকতা, গসিপ আর বিশ্রামের এক নরম মুহূর্ত।
ভারত: রাস্তার মোড়ের কড়া চা

ছোট কাচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা কড়া চা—এ যেন জীবনের চালচিত্র, ছবি: রয়টার্স
ভারতবর্ষে চা যেন জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে চায়ের দোকান মানেই খবর, তর্ক, রাজনৈতিক আলোচনা, আর বন্ধুত্বের আসর। আদা-মশলা মিশ্রিত মাসালা চা কিংবা ছোট কাচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা কড়া চা—এ যেন জীবনের চালচিত্র। অতিথি এলে আপ্যায়নে তো আছেই!
মরক্কো: মিন্ট চা আর আতিথেয়তার প্রতীক

মরক্কোর আটাই মিন্ট টি এভাবে পরিবেশন করা হয়, ছবি: দ্যা এটিকেট কনসালট্যান্ট
মরক্কোয় চা মানে আতিথেয়তা। আটাই মিন্ট টি—সবুজ চা, টাটকা পুদিনা আর প্রচুর পরিমাণে চিনি দিয়ে তৈরি এই চা অতিথিদের বরণে অপরিহার্য। এটি তিনবার পরিবেশন করা হয়—প্রথম কাপ সাধারণ অনেকটা জীবনের মতো। দ্বিতীয়টি ভালোবাসার মতো কড়া। এবং সর্বশেষ কাপ মৃত্যুর মতোই তিক্ত স্বাদের। এ যেন চায়ের কাপে জীবনের গল্প।
চীন: চায়ের আদি ভূমি

বৈচিত্র্যে ভরা চীনের চা, ছবি: চায়না টি স্পিরিট
চীনে চায়ের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। সেখানকার উলং, পুয়ের, জেসমিন টি ইত্যাদি নানা ধরনের চা বৈচিত্র্যে ভরা। চীনা চা পরিবেশনেও থাকে নির্দিষ্ট অনুশাসন, ধ্যান ও সংযম। স্বাস্থ্যগত উপকারিতার কথাও খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
বাংলাদেশ: “চা খাবেন?” – আমাদের আতিথেয়তার প্রথম বাক্য

বাং;লাদেশের অলিগলিতে ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে আড্ডার নিত্যসঙ্গী চা, ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে চা শুধুমাত্র একটি পানীয় নয়, এটি একটি আবেগ। সকালে ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে বিকেলের আড্ডা, অফিসের ফাঁকে, ট্রেনের জানালায়, এমনকি মাঝরাতের চুপচাপ সময়ে—চা সবসময় সঙ্গী। শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়—দেশজুড়ে বিস্তৃত সবুজ চা-বাগান শুধু উৎপাদনের জায়গাই নয়, বরং এ দেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ‘টু-টো চা’, মালাই চা বা সাত রঙের চা আমাদের চায়ের প্রতি প্রেমের এক জীবন্ত প্রমাণ।
বিশ্বজুড়ে চা যেন এক এক দেশের আত্মার প্রতিচ্ছবি। জাপানের ধ্যান, ইংল্যান্ডের পরিপাটি সভ্যতা, ভারতের গরম গরম বিতর্ক, মরক্কোর মিষ্টি আতিথেয়তা, চীনের প্রাচীন ভারসাম্য—সব মিলিয়ে এই পানীয়টা অনেক বেশি কিছু। আর আমাদের কাছে চা মানেই সম্পর্ক, উষ্ণতা, নরম আলো-আঁধারি আর হাজারো গল্প।