সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতের ক্লান্ত দেহ বিছানায় পড়া পর্যন্ত—একজন কর্মজীবী মায়ের দিনটা যেন অবিরাম ছুটে চলা। অফিসের সময়মতো পৌঁছানো, সন্তানের স্কুলের দায়িত্ব, সংসারের নানা প্রয়োজন, পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা—সবকিছু সামলে নিজের জন্য একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও মেলে না। এই ব্যস্ততায় নিজের শরীর-মনকে অনেকেই একেবারে উপেক্ষা করে যান। অথচ এই ‘নিজেকে ভুলে থাকা’ অভ্যাসটাই ধীরে ধীরে জন্ম দেয় মানসিক চাপ, অবসাদ, এমনকি উদ্বেগের মতো জটিল সমস্যার।
“আমি তো ঠিক আছি”—আসলে কি তাই?
বাংলাদেশে কর্মজীবী মায়েদের বড় একটি অংশই মানসিক স্বাস্থ্যের সংকটে ভুগছেন—অনেকেই তা বুঝতে পারেন না, আবার কেউ বুঝেও গুরুত্ব দেন না। মানসিক চাপ, অপরাধবোধ, ‘সব ঠিকঠাক রাখার’ চাপ, কাজ ও পরিবারকে একসঙ্গে সামাল দেওয়ার ক্লান্তি—এসব মিলে তারা একসময় একধরনের মানসিক নিঃসঙ্গতায় ডুবে যান। অনেকে আবার ভাবেন, “আমি দুর্বল নই, মানসিক সমস্যায় কীভাবে পড়ি?” এই মনোভাবই আরও গভীর করে তোলে সংকটকে।

একজন কর্মজীবী মায়ের দিনটা যেন অবিরাম ছুটে চলা, ছবি: দ্যা হিন্দু
দ্বৈত ভূমিকার ভার
কর্মজীবী মায়েরা প্রতিদিন একটা অদৃশ্য যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যান। সকালে উঠে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর ঝক্কি বা ছোট শিশুসহ পরিবারের সবার খাবারের বন্দোবস্ত করা, রান্নাঘরের ধোঁয়া, অফিসের টাইমলাইন মেলানোর দৌড়, আবার সন্ধ্যায় ফেরার পর সংসারের ব্যস্ততা—সবকিছুর মাঝে কোথাও একটা “আমি” হারিয়ে যায়।
এই দৌড়ঝাঁপ শুধু শারীরিক ক্লান্তি আনে না, মানসিকভাবেও একসময় ক্লান্ত করে ফেলে। সবসময় সবার মুখে হাসি রাখার দায়, ভুল করলেই অপরাধবোধ, কিংবা নিজের জন্য সময় চাইলে আত্মকেন্দ্রিক মনে হওয়া—সব মিলে একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
‘আদর্শ মা’ হওয়ার চাপ
“ভালো মা হতে গেলে সব ত্যাগ করতে হয়”—এই ধারণা এখনো সমাজে গেঁথে আছে। অথচ সত্যি হলো, একজন সুখী মা-ই পারে একটা সুস্থ পরিবার গড়তে। কিন্তু কর্মজীবী মায়েরা এই পারফেকশনের চাপে বারবার নিজের চাহিদা, নিজের স্বপ্নকে চাপা দেন।
অনেক সময় পরিবারের লোকজনও বুঝে উঠতে পারেন না মায়ের এই ক্লান্তি। বরং অভিযোগ করেন—”তোমার তো অফিস আছে, সংসারটা ঠিকমতো দেখো না!”

কর্মজীবী পরিচয়ের সঙ্গে মাতৃত্বের ভূমিকা মেলাতে গিয়ে অনেকেই নিজের ‘স্বত্বা’ হারিয়ে ফেলেন, ছবি: দ্যা চাম্পা ট্রি
সমস্যার শিকড় কোথায়?
- সমাজের প্রত্যাশা। একজন মা সব সামলাবেন—এ ধারণাটা আজও প্রচলিত।
- কর্মজীবী পরিচয়ের সঙ্গে মাতৃত্বের ভূমিকা মেলাতে গিয়ে অনেকেই নিজের ‘স্বত্বা’ হারিয়ে ফেলেন।
- বিশ্রামের অভাব। মানসিক সুস্থতার অন্যতম শর্ত, বিশ্রাম ও নিজের সময়। কিন্তু কর্মজীবী মায়েদের এই সময় বের করাটাই সবচেয়ে কঠিন।
- সহায়তার অভাব। পরিবার, অফিস বা সমাজ—সব জায়গায় সহযোগিতার ঘাটতি মানসিক চাপে ইন্ধন জোগায়।
সমাধানের কিছু পথ
এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- নিজেকে সময় দিন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্য রাখুন। বই পড়ুন, হাঁটুন বা শুধু একা থাকুন।
- ‘না’ বলতে শিখুন। সবকিছু নিজে করতে হবে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। প্রয়োজনে দায়িত্ব ভাগ করুন।
- সহায়তা চাওয়া দুর্বলতা নয়: পারিবারিক বা পেশাগত সহযোগিতা চাওয়াকে স্বাভাবিক করে তুলুন।
- এগিয়ে আসতে হবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, সন্তান—সবার উচিত মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বোঝা।
- মানসিক স্বাস্থ্যচিকিৎসা নেওয়া। ক্লিনিক বা অনলাইন কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নেওয়া এখন সহজ। সংকোচ না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
- সামাজিক সংযোগ রক্ষা করুন। পরিবারের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, নিজের মতো কিছু শখ বজায় রাখুন।
একজন মায়ের সুস্থতা মানে শুধুই তার নয়, একটি পরিবারের সুস্থতা, এমনকি সমাজের মঙ্গলও। কর্মজীবী মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনই উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আমরা আরও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হব। তাই, সমাজ, পরিবার, এবং নীতিনির্ধারকদের উচিত—এমন এক পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে একজন মা নিজের যত্ন নিতে পারেন আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তির সঙ্গে।