ডামপ্লিং—এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৈচিত্র্যময় এক বিশ্বরান্নার গল্প। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে ডামপ্লিং ধরা দিয়েছে হাজারো স্বাদের মোড়কে। ডামপ্লিং হল একধরনের খাবার, যেখানে ময়দা বা আটার তৈরি মোড়কে (ডো বা র্যাপার) ভরে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের পুর—যেমন মাংস, মাছ, সবজি, পনির কিংবা মিষ্টি উপকরণ। এরপর সেই মোড়ানো খাবারটিকে সাধারণত সিদ্ধ (boiled), বাষ্পে রান্না (steamed), ভাজা (fried) বা বেক করা হয়।
বর্তমানে বৈশ্বিক খাবারের ট্রেন্ডে এর জনপ্রিয়তা রকেটের গতিতে বেড়েই চলেছে। অবশ্য এর বেশি কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, বিশ্বায়ন এবং ফিউশন ফুডের উত্থান। ভিন্ন সংস্কৃতির খাবারের প্রতি আগ্রহ বিশ্বব্যাপী। নেপালি মোমো, জাপানি গিয়োজা, কোরিয়ান মান্ডু, ইতালিয়ান র্যাভিওলি—সবকিছুই এখন এক ছাদের নিচে পাওয়া যাচ্ছে। ক্রস-কালচারাল রান্নার মাধ্যমে ডামপ্লিং এক নতুন ফিউশন আইকনে পরিণত হয়েছে, এবং শহুরে তরুণেরা একে নিজের করে নিয়েছে।

ফুড ব্লগারদের কাছেও তাই ডামপ্লিং একটি “ইনস্টা-ওয়ার্দি” খাবার, ছবি: ফ্রিপিক
অন্যদিকে ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউবের যুগে খাবার শুধু স্বাদের নয়, দেখারও বিষয় হয়ে উঠেছে। নানা আকৃতির, রঙিন, পারফেক্টলি মোড়ানো ডামপ্লিংগুলো ছবি ও ভিডিওতে দারুণভাবে তুলে ধরা যায়—ফুড ব্লগারদের কাছেও তাই এটি একটি “ইনস্টা-ওয়ার্দি” খাবার।
ডামপ্লিং সহজে বহনযোগ্য, দ্রুত রান্না করা যায়, আর রোডসাইড স্টল বা ফুড ট্রাকে সহজে পরিবেশনযোগ্য। তাই শহরাঞ্চলের ব্যস্ত জীবনে এটি এক আদর্শ স্ট্রিট ফুড। ঢাকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলোতে মোমোর স্টল এখন খুবই জনপ্রিয়।
আসুন, এবার ঘুরে আসা যাক এই ক্ষুদে কিন্তু চমকপ্রদ খাবারের বৈচিত্র্যময় জগত থেকে-
চীন – জিয়াওজি (Jiaozi):
চীনা নববর্ষে ‘জিয়াওজি’ যেন এক অপরিহার্য পদ। পাতলা ময়দার চাদরে মোড়া পর্ক (শুয়োরের মাংস), বিভিন্ন ধরনের সবজি, বিশেষ করে নাপা ক্যাবেজ বা বাঁশ কোড়ল—ভেতরে ভরপুর স্বাদ, আর বাইরে নরম তুলতুলে গড়ন। স্টিম, ফ্রাই বা সিদ্ধ করে খাওয়ার প্রচলন থাকলেও স্টিমড জিয়াওজি-ই সবচেয়ে জনপ্রিয়। শুধু খাওয়ার জন্য নয়, পরিবার নিয়ে একসাথে বসে ডামপ্লিং তৈরি করাও চীনা সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।

স্টিম, ফ্রাই বা সিদ্ধ করে খাওয়ার প্রচলন থাকলেও স্টিমড জিয়াওজি-ই সবচেয়ে জনপ্রিয়, ছবি: থার্টি সেকেন্ডস
জাপান – গিয়োজা (Gyoza):
চীনের জিয়াওজির প্রভাবে তৈরি হলেও জাপানি গিয়োজা একটু ভিন্ন। পাতলা ডো, তীব্র রসুনের স্বাদ এবং প্যান-ফ্রায়েড হওয়ায় এর তলাটা খাস্তা আর উপরের দিকটা তুলতুলে। সাধারণত সয়া সস আর ভিনেগারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়, সাইড ডিশ হিসেবেই নয়, স্ন্যাক হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয়।

গিয়োজার ডো পাতলা, স্বাদ তীব্র রসুনের এবং প্যান-ফ্রায়েড হওয়ায় এর তলাটা খাস্তা আর উপরের দিকটা তুলতুলে, ছবি: জাপান সেন্টার
নেপাল – মোমো (Momo):
বাংলাদেশে যে নামটি সবচেয়ে পরিচিত—মোমো। কাঠমান্ডু থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত এর জয়যাত্রা। মুরগি, গরু বা সবজির পুর ভরে তৈরি হয় এই স্টিমড বা ফ্রায়েড ডামপ্লিং। সঙ্গে পরিবেশিত হয় ঝাল টমেটো চাটনি—যা এক কামড়েই মোমোর স্বাদকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশি তরুণদের মন জয় করেছে নেপালি মোমো, ছবি: শর্টপিডিয়া ভয়েসেস
পোল্যান্ড – পিয়েরোগি (Pierogi):
ইউরোপীয় এই ডামপ্লিংগুলো একটু ভারী ধরনের। আলু, পনির, বাঁধাকপি কিংবা মাংস দিয়ে তৈরি পুর, মাঝে মাঝে মিষ্টিও হয়—চেরি বা ব্লুবেরি দিয়ে। সিদ্ধ করে, এরপর মাঝে মাঝে হালকা করে ভেজেও খাওয়া হয়। শীতকালে গরম পিয়েরোগি পোলিশদের জন্য এক সান্ত্বনার খাবার।

পিয়েরোগি ঝাল হয় আবার মিষ্টিও হয়, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
তুরস্ক – মানতি (Manti):
ক্ষুদ্রাকৃতির এই ডামপ্লিং ভরা থাকে মাংসের পুরে। সাধারণত দই আর রসুনের সসে পরিবেশিত মানতি স্বাদে যেমন অনন্য, তেমনি দেখতে একরকম শিল্পকর্মের মতো। তুরস্কের এই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায়ও ব্যাপক জনপ্রিয়।

মানতি কোন সাধারণ খাবার নয়, যেন এক শিল্পকর্ম, ছবি: ট্র্যাভেল অ্যাটেলিয়ের
ইতালি – র্যাভিওলি (Ravioli):
ডামপ্লিং হয়ত প্রথমে এশিয়াতেই জনপ্রিয়তা পায়, কিন্তু ইউরোপে এর ইটালিয়ান রূপ—র্যাভিওলি, রীতিমত গোরমে (gourmet) স্তরে উন্নীত হয়েছে। পনির, পালং শাক, মাংস বা স্কোয়াশ দিয়ে তৈরি পুর, আর তা ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে পরিবেশন করা হয় টমেটো বা ক্রিম সসের সঙ্গে।

পাস্তা আর ডামপ্লিংয়ের এক অনন্য শঙ্কর রাভিওলি, ছবি: পাস্তা ইভাঞ্জেলিস্টস
লাতিন আমেরিকা – এম্পানাদা (Empanada):
যদিও এম্পানাদা কিছুটা প্যাস্ট্রির মতো, তবে এর মোড়ানো রূপ এবং পুরভর্তি প্রকৃতিই একে ডামপ্লিংয়ের পরিবারে জায়গা দেয়। ভাজা বা বেকড, আর মাংস, পনির বা মিষ্টি পুর—এম্পানাদার সম্ভার এককথায় অপরিসীম।

ভাজা বা বেকড, আর মাংস, পনির বা মিষ্টি পুর—এম্পানাদার সম্ভার এককথায় অপরিসীম, ছবি: টেস্কো রিয়াল ফুড
ডামপ্লিংয়ের দুনিয়া সীমাহীন। প্রতিটি সংস্কৃতিতে, প্রতিটি অঞ্চলে এই ছোট্ট খাবারটির রয়েছে ভিন্ন এক পরিচয়, এক গল্প। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি—কিন্তু একই আত্মা: মানুষকে একত্রে নিয়ে আসা, ভাগ করে খাওয়ার আনন্দে।