আজরা মাহমুদের বেড়ে ওঠা ধানমন্ডিতে মা-বাবা ও বড় ভাই এবং বিশাল এক যৌথ পরিবারের মাঝে। তাঁর বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। অবসর গ্রহণ করলেও আজরার বাবা আর্মিদের লাইফস্টাইল ত্যাগ করতে পারেননি। এজন্য আজরাও ছোটবেলা থেকে বেশ ডিসিপ্লিনের মধ্যে বড় হয়েছেন। যার প্রভাব এখনও তাঁর মধ্যে রয়েছে। তবে এত ডিসিপ্লিনের মধ্যেও যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার আনন্দ থেকে আজরা বা তাঁর ভাই কখনো বঞ্চিত হননি।
আজরা ছোটবেলা থেকে একজন ম্যাচিউরড ও বাস্তববাদি মানুষ। কারণ তাঁর মা তাঁকে সেভাবে বড় করেছেন। অন্যান্য বাবা মায়েরা যেমন কোন কিছু করার জন্য জোর করে বা কোন কাজ করতে মানা করে, আজরার মা এমন করতেন না। তিনি প্রতিটি কাজের পরিণতি বুঝিয়ে বলে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আজরার হাতে ছেড়ে দিতেন। সিদ্ধান্ত থেকে ভুল করলেও তাতেও তাকে কেউ বাঁধা দিতেন না। কারণ আজরার মা চাইতেন এই ভুল থেকে যেন সঠিক শিক্ষাটা তিনি গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে একটি স্বাধীনচেতা ও বিচক্ষণ মনের অধিকারী হয়ে উঠেছেন আজরা। এ থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা কত জরুরি। তাই আজরা ও-লেভেল পাস করে মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পাশাপাশি বাসাও টিউশনি করাতেন। এর মধ্যে এ-লেভেলের পড়াশোনাও করেছেন সমানতালে। এ-লেভেল পাস করার পর তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডনে ‘লং ডিসট্যান্স প্রোগ্রামে গ্রাজুয়েশন করেন।

অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজরা মাহমুদ হয়ে উঠেছেন দেশের শীর্ষ ফ্যাশন কোরিওগ্রাফার, ছবি: বিবিসি
আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছা থেকে শিক্ষকতা শুরু করলেও আজরা ছোটবেলা থেকে ডাক্তার হতে চাইতেন। তবে সেই ‘ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা’ কিভাবে ‘মডেল হওয়ার ইচ্ছায়’ পরিণত হলো সেই গল্প করতে গিয়ে আজরা বলেন, ‘ ছোটবেলায় সময় পেলেই এফটিভি দেখতাম। মডেলরা সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে হেঁটে আসছে আবার চলে যাচ্ছে। শুধু যে তারা আসছে আর যাচ্ছে তা কখনো মনে হতো না। মডেলরা দর্শকের সামনে যে ব্র্যান্ডের পোশাক পরে আছে সেটার সাথে নিজেকে উপস্থাপন করছে এবং সেই ব্র্যান্ডটাকে যথাযথভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছে তাও আবার মুখ বন্ধ করে, শুধুমাত্র হাঁটা ও অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যমে একটি ব্র্যান্ডের আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলাটা বিশাল একটা ব্যাপার বলে মনে হতো আমার কাছে। র্যাম্পে দাঁড়িয়ে ভুল করার কোন সুযোগ নাই। মানুষ যখন ফ্যাশন শো দেখে তখন মনে করে মডেলরা আসলো আর গেল কিন্তু বিষয়টা আসলে এতোটা সহজ না। এসব দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতেই মনের ভেতরে একটা মুগ্ধতার জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।’ মুগ্ধতা থাকলেও কখনো চিন্তা করেননি মডেল হবেন। তবে একদিন পত্রিকা পড়তে পড়তে ‘মডেল চাই’ শিরোনামের বিজ্ঞাপন দেখে আজরার হঠাত মনে হয়েছিল তিনি একটিবারের জন্য চেষ্টা করে দেখবেন।
সেই ভাবনা থেকেই ২০০১ সালে সে ‘এভেলুশন’ নামে একটি মডেলিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যা পরিচালনা করতেন কৌশিকি নাসের তুপা। তুপা ছিলেন বাংলাদেশের সে সময়ের সেরা মডেল। তিনি আজরার জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। মডেলিংয়ের কথা ভাবার আগেই সে আড়ংয়ের সামনে তুপার ছবি দেখে মুগ্ধ হতো এবং বিস্ময়ভরে ভাবত, দেশে এমন আন্তর্জাতিক মানের মডেলও আছেন! তবে মজার ব্যাপার হলো, যখন সে ‘এভেলুশন’-এ যায়, তখনো জানত না যে এটি তুপার প্রতিষ্ঠান। কলিংবেল চাপতেই দূর থেকে একটি লম্বা, অনন্য মুগ্ধতা ছড়ানো মেয়ে তার দিকে আসতে থাকে। কাছে আসতেই সে অবাক হয়ে যায়—এই সেই তুপা, যাকে দেখে মডেলিংয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল! আজও সেই মুহূর্তটি তার মনে স্পষ্ট ভাসে। সেখানে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর, একই বছরের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো র্যাম্পে হাঁটার সুযোগ পায়। এভাবেই তার মডেলিং-জীবনের সূচনা হয়।
তবে শুরুটা খুব একটা সহজ হয়নি আজরার জন্য। বেশ বাধাবিপত্তি ছিল। সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই আজরা এগিয়েছেন। এই নিয়ে তিনি বলেন, ‘তুপা আমাকে শক্ত হতে সাহায্য করেছিল। আমি উচ্চতায় শর্ট ছিলাম। র্যাম্প মডেলিং করতে চাই জেনে তুপা আমাকে সরাসরি বলেছিল যে আজরা আমি তোমাকে কতটুকু সহযোগিতা করতে পারবো জানিনা কারণ তুমি বেশ খাটো। তারপরেও তুমি চাইলে শিখতে পার। তুপা আমাকে এই কথা বলে হতাশ করেনি বরং নতুনভাবে চেষ্টা করার কিংবা অন্যভাবে কিছু করার আগ্রহ জুগিয়েছিল। তখন ভেবেছি আমি যদি নিজের ভেতর থেকে এমন কিছু একটা বের করতে পারি যা অন্যের মধ্যে নাই তাহলে অডিশনের সময় হয়তো আয়োজকরা ও ডিজাইনার আমাকে সিলেক্ট করবে। আমি প্রতিদিন তিন চার ঘন্টা করে বাসায় আয়নার সামনে হাঁটতে লাগলাম। এমনভাবে হাঁটার চেষ্টা করতে থাকলাম যেটা অন্য কেউ করেনি। ভেরিয়েশন আনার চেষ্টা করতাম। নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করতে না পারলে টিকে থাকা যাবে না বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রথম বাঁধা ছিল আমার উচ্চতা। সেটাকে কাটিয়ে উঠতে আমাকে এভাবেই কষ্ট করতে হয়েছে।’ পরিশ্রমের ফসলও তিনি পেয়েছিলেন খুব অল্প সময়ে। ২০০২ সালে তিনি অংশ নেন ‘ইউ গট দ্য লুক’ বিউটি কনটেস্টে। সেখানে তিনি ‘বেস্ট লুক’ অ্যাওয়ার্ড পান।
তবে এখানে আরেকটি বাঁধার কথা না বললেই নয়। পারিবারিক বাঁধা। মডেলিং পেশাটাকে সেসময় খুব ভালো চোখে দেখা হতো না। সেদিক থেকে তাঁর বাবাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। আজরা বলেন, ‘২০০২ সালে ‘ইউ গট দ্য লুক’ বিউটি কনটেস্টে অংশ নেই। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছি বিষয়টা জানাতে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমাদের বাসায় একদিন একটা ফোন কল আসে। সেই ফোন ধরলেন আব্বা। আব্বা প্রথমে বিশ্বাসই করেননি। পরে তাদের জানিয়ে দেন তাঁর মেয়ে এইসবে অংশ নিবে না। আমি বাসায় ফিরলে আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি তখন বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছিলাম অসম্ভব! আমি তো জানিই না। আমার কোন বন্ধু হয়তো দুষ্টুমি করে আমার ছবি পাঠিয়েছে। আমার কথা শুনে আব্বা আশ্বস্থ হয়েছিলেন।’ বাবার কাছ থেকে এভাবে নিজের মডেলিং ক্যারিয়ার লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন ২০০৪ সাল পর্যন্ত। অন্যদিকে আজরার মা ছিলেন বাবার একদম উল্টো। মেয়েকে তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে যত্ন করে তা লুকিয়ে রাখতেন পাছে বাবার হাতে না পড়ে!

দেশের লাখো তরুণ-তরুণীদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন আজরা মাহমুদ, ছবি: সংগৃহীত
আজরার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০০৪ সাল। এ সময়ে আজরার মনে হয়েছিল তিনি মডেলিং ক্যারিয়ারটা ছাড়তে চান না। তবে এখানে কাজের সুযোগ কম। বছরে মাত্র ৪টা র্যাম্প শো হয় । তখন এত ব্র্যান্ডও ছিল না যে অনেক কাজ পাওয়া যাবে। যে টাকা দিত তাও খুব বেশি না। তখন আজরা চিন্তা করলেন কোরিওগ্রাফি শুরু করার কথা। ২০০৪ সালে প্রথম কোরিওগ্রাফি করেন ‘ইউ গট দ্য লুক’ প্রতিযোগিতায়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় টুকটাক কাজ করেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তাঁকে বেশ স্ট্রাগল করতে হয়। ২০০৭ সালে কোরিওগ্রাফির মেইনস্ট্রিমে আসি লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। শুধু কোরিওগ্রাফি নয়, আজরা উপস্থাপনায়ও বেশ পারদর্শী ছিলেন। ২০০৪ সালেই সানসিল্ক অপ্সরা’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে উপস্থাপনা শুরু করেন। ঐ একই বছর অভিনয় করেন আফসানা মিমি পরিচালিত ধারাবাহিক ‘ডলস হাউজ’-এ। ২০০৭ সালে র্যাম্প মডেলিং ছেড়ে দিয়ে তিনি শুধু উপস্থাপনা ও কোরিওগ্রাফিতে মনোনিবেশ করেন।
এক সময় তিনি উপলব্ধি করলেন, আমাদের দেশের মডেলরা আসে কোন বিউটি কনটেস্টের মাধ্যমে বা কোন ফটোগ্রাফারের কাছে ছবি তুলে। অথবা কাউকে কোনভাবে ম্যানেজ করেও মডেল হয়ে যাওয়ার নজির আছে। বিদেশে মডেল তৈরি করে এজেন্সি, রিক্রুট করে এজেন্সি। তারা বিভিন্ন গ্রুমিং ও সেলফ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে একজন মডেল তৈরী করে। আমাদের দেশেও এরকম ভাবেই মডেলিং করতে আসা ছেলে-মেয়েদের তৈরী করার একটি তাগিদ অনুভব করেন তিনি। সেই প্রয়াস থেকে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের ‘আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্প’। এই ক্যাম্পটি বর্তমানে মডেলদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞানকে আরও বিকশিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর সাথে মডেলদের বিশ্বমানের উপযোগী করে গড়ে তুলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে। আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ফেস অব এশিয়া এবং মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের মতো মূল পর্বের শীর্ষ দশে জায়গা করে নেওয়া মডেল তৈরি করেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ফেস অব এশিয়া এবং মিস অ্যান্ড মিস্টার সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনালের জাতীয় পরিচালক হিসেবে কাজ করেছে। গত বছর পেয়েছে বিশ্বের শীর্ষ তিনটি প্যাজেন্টের মধ্যে একটি মিস ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য আজরা মাহমুদ সম্মানিত হয়েছে ‘নুরুল কাদের সম্মাননা ২০২৩’–এ।
বর্তমানে কোরিগ্রাফি ও এএমটিসি নিয়ে ব্যস্ত আজরা। সময় যত এগিয়েছে বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে আজরা আরও উজ্জ্বল হয়েছেন। নিজেকে এই কাজে বানিয়েছেন এক। অদ্বিতীয়। দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন আজরা আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম স্তম্ভ। লাখো তরুণ-তরুণীদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণার সংজ্ঞা। একজন ‘আইকন’।