একজন ফোলেই শিল্পী আসলে চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে এবং রেডিওর জন্য সাউন্ড ইফেক্ট (sound effect) বা শব্দের প্রভাবকে পূনরায় তৈরি করে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের সাজ সরঞ্জাম যেমন, হরেক পদের জুতো, প্লেট, গ্লাস, চেয়ার, পানি, কাপড়, বিভিন্ন রকমের আওয়াজ করে এমন ঘণ্টা ইত্যাদি নানাজাতের জিনিস দ্বারা তারা আসল শব্দটির অর্থাৎ, চিত্রগ্রহণের সময় যে শব্দটির সৃষ্টি হয় বা কল্পনা করা হয় তার ঠিক অনুরূপ এবং উন্নতমানের একটি শব্দের জন্ম দিয়ে থাকেন। আসল দৃশ্য ধারণ করার সময় এই শব্দগুলো খুব নিম্নমানের হয় যা ধারণ করা কঠিন। অনেকসময় মিথ্যা সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সঠিক শব্দের সৃষ্টিও হয় না। তাই দৃশ্যমাধ্যমকে বাস্তব করে তুলতে ফোলেই শিল্পের গুরুত্ব অনেক।
এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে চিত্রগ্রহণের সময়ই তো শব্দ ধারণ করা হয়। তাহলে এই শিল্পের প্রয়োজন কেন? আসলে কিন্তু একটা ফিল্ম সেটের বেশিরভাগ জিনিসই বাস্তব নয়। সেগুলোকে বাস্তবের মতো রূপদান করা হয় মাত্র। যেমন- তলোয়ার গুলো হয় প্লাস্টিকের, প্লাই উডের মেঝের উপর মার্বেলের মেঝের মতন রঙ করা হয় এমন আরও অনেককিছু। ফোলেই শিল্পীরা এই শব্দটিকেই প্রতিস্থাপন করে আরও আকর্ষণীয় করে তোলেন। তখন প্লাস্টিকের তলোয়ার হয়ে যায় ধাতুর আর প্লাই উডের মেঝে হয়ে যায় মার্বেলের।
তাই বলে কোন ছবির সব ধরনের ব্যাক গ্রউন্ড মিউজিক ফোলেই শিল্পীরা করে থাকেন ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। যেমন, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, পশু-পাখির ডাক, বিস্ফোরণের আওয়াজ ইত্যাদি। তারা মূলত ছবিটির খুঁটিনাটি শব্দের যোগান দিয়ে দৃশ্যগুলোকে দর্শকদের কাছে আরও জীবন্ত করে তোলেন। ফোলেই শিল্পী দলের বিন্যাসটা অনেকটা এরকম:
- ফোলেই শিল্পী
- ফোলেই সম্পাদক (যিনি ফোলেই শিল্পীর দ্বারা সৃষ্ট শব্দটির ডিজিটাল সম্পাদনা করেন)
- ফোলেই সমন্বায়ক (যিনি ফোলেই শিল্পীর সাথে কাজ করেন তার সৃষ্ট শব্দটি ধারণ করার জন্য)

জ্যাক ফোলেই (১৮৯১-১৯৬৭)ইং। ছবি: সিনে মনতাজ
ফোলেই শিল্পের জনক হলেন জ্যাক ফোলেই (Jack Foley) (১৮৯১-১৯৬৭)ইং। তিনি যখন চলচ্চিত্র নির্দেশনায় আসেন তখন সেটা ছিল নির্বাক ছবির যুগ। নির্দেশনা শেষে তিনি স্টুডিওতে প্রচুর সময় ব্যয় করতেন শব্দ সংযোজনের জন্য। ক্লোজ-আপ মুভমেন্টের (close up movement) শব্দগুলোকে উনি প্রাধান্য দিতেন। একে একে উনার প্রতিটি ছবিতেই শব্দ সংযোজিত হতে থাকে এবং সেগুলো ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। আধুনিক প্রযুক্তির ভিড়েও Foley শিল্প এখনো অপরিহার্য। তাই এই শিল্পকে বলা হয় ‘trick of trade’! জ্যাক ফোলেই তাঁর অসাধারণ কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ কিছু সম্মাননা পদক অর্জন করেন। চলচ্চিত্র জগতে তিনি চিরস্মরণীয়।
একটি সম্পূর্ণ Foley track এ প্রধানত তিনটি উপাদান থাকে-
১. Moves বা নড়াচড়ার শব্দ
Move track হল শব্দের সেই স্তরটি যেখানে একজন অভিনেতার হাঁটা, দৌড় অথবা যেকোনো নড়াচড়ার ফলে সৃষ্ট কাপড়ের খসখসে শব্দের পুনর্জন্ম করানো হয়। আমরা যখন ঘরের মাঝেই হেঁটে বেড়াই, এক গ্লাস পানি নেই বা হাত নড়াচড়া করি তখনো কিন্তু আমাদের পোশাকের সাথে শরীরের ঘর্ষণের ফলে শব্দের সৃষ্টি হয়। মানুষ মাত্রই আঁচড় কাটবে, পিঠ চাপড়াবে, একে অন্যকে স্পর্শ করবে। আর এসব শব্দ তৈরি করায় হল Move track এর কাজ।

নড়াচড়ার শব্দ ধারণ করছেন ফোলেই শিল্পী। ছবি: ব্যাকস্টেজ
২. Footstep বা পদশব্দ
ফোলেই শিল্পীকে কখনও ফোলেই ওয়াকার (Foley walker) আবার কখনোবা ফোলেই স্টেপার (Foley stepper) বলা হয়। কারণ ফোলেই শিল্পীদের কাজের মাঝে পদশব্দ বেশি গুরুত্ব রাখে। এমনকি অভিনেতার বাজে উপস্থাপনও শুধুমাত্র পদশব্দের জন্যই নজর এড়িয়ে যায়। প্রত্যেকটি চরিত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদশব্দ তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে surface বা পৃষ্ঠতল এবং চরিত্রের অনুভূতির উপর নির্ভর করেই মূলত শব্দগুলো নির্মাণ করা হয়। পৃষ্ঠতলটি হতে পারে কাঠের, মার্বেল বা কাঁচা রাস্তার। আবার কোনো চরিত্রের অনুভূতি হতে পারে গুরুভার, দ্রুত, ক্ষিপ্ত, আতঙ্কিত ইত্যাদি।
ফোলেই শিল্পের মাঝে পদশব্দ সৃষ্টি করাটাই হল সব থেকে কঠিন। এরজন্য চরিত্রের সঠিক অনুভুতির সাথে ক্রমাগত মহড়ার প্রয়োজন। ফোলেই শিল্পীর পুরো ঘরময় ছুটে বেড়ানোর স্বাধীনতা নেই। কারণ শব্দধারণের মাইকটি এক জায়গাতেই সাঁটা থাকে আর এতো জায়গা নেয়াও সম্ভব নয়। যার ফলে কাজটা হয়ে ওঠে আরও চ্যালেঞ্জিং। একারণে ফোলেই শিল্পীদের থাকে সাজ সরঞ্জামের এক বিশাল ভাণ্ডার। নানা পদের জুতো আর মেঝের ছোট আকারের নমুনা পদশব্দ ধারণের জন্য অপরিহার্য।

পদশব্দ ধারণ করছেন ফোলেই শিল্পী। ছবি: ইন্ডিয়া মার্ট
৩. Specifics বা সুনির্দিষ্ট কোন শব্দ
নড়াচড়া (Moves) বা পদশব্দ (Footstep) ছাড়া বাকি সব শব্দই Specifics বা সুনির্দিষ্ট কোন শব্দের অন্তর্ভুক্ত। সুনির্দিষ্ট শব্দ হলো ফোলেই শিল্পের সব থেকে মজার জায়গা। কারণ এখানেই শিল্পী তার সৃষ্টিশীলতার উন্মাদনায় মেতে ওঠেন। নিচে তারই কিছু উদাহরণ দেয়ে হলো:
– ভুট্টার বীজকে চামড়ার ব্যাগে নিয়ে সেটা দিয়ে বরফ ভাঙ্গার মচমচ আওয়াজ করানো যায়।
– এক জোড়া দাস্তানার সংঘর্ষের শব্দটি শোনায় ঠিক পাখির ডানা ঝাপটানোর মতন।
– একটি পুরনো চেয়ার থেকে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তৈরি করানো যায়।
– ক্যাসেটের ফিতার মাধ্যমে ঘাসের বা ব্রাশের মতো শব্দ সৃষ্টি করা যায়।
– একটি মোটা পেঁচানো টেপ দিয়ে আটকানো টেলিফোন বইতে ঘুষি মারার মধ্য দিয়ে কোন মানুষকে ঘুষি মারার শব্দ তৈরি করা যায়।
অর্থাৎ, বাস্তবে যা ব্যবহৃত হয় তা দিয়ে নয় বরং আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপাদান গুলো নিয়ে ফোলেই শিল্পী এই সুনির্দিষ্ট শব্দগুলো তৈরি করে থাকেন। যেটি আসলেই অসাধারণ!
কি করে একজন ফোলেই শিল্পী হওয়া যায় এমনটা ভাবলে কিছুটা সমস্যাই আছে বলা যায়। কারণ এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যে পরিমাণ চল রয়েছে এই শিল্পের তাতে এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থাকলে অনেকেই উপকৃত হতে পারত এবং সেই সাথে আমাদের চলচ্চিত্রের মান আরও উন্নত হতো।
ফোলেই শিল্পীরা হলেন কোনো চলচ্চিত্রের টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ দলের একটি অংশ। কোনো ঘটনার হুবুহু অনুকরণই এই শব্দ সৃষ্টির একমাত্র উপায় নয়। কাঙ্ক্ষিত সেই শব্দ সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা থাকা চাই পাশাপাশি ঠিক কি করলে বিভিন্ন সাজ সরঞ্জাম দ্বারা ঐ শব্দটিকে সৃষ্টি করা যায় সেটিও জানা আবশ্যক। সুতরাং, ফোলেই শিল্পটি হল এমন একটি শিল্প যেটি ভীষণভাবে পর্যবেক্ষণ, ধৈর্য ও নিখুঁত হওয়ার দাবি রাখে। আমাদের দেখা বেশিরভাগ চলচ্চিত্র, টেলিভিশন সিরিজ এবং রেডিওতে এর ব্যবহার হয়েছে। প্রতিটি বস্তুর নড়াচড়া, বৃষ্টির শব্দ, সমুদ্রের শব্দ, পদশব্দ এতটাই নিখুঁত ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে যে আমরা সেটা নকল ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ পাইনি। বরং প্রতিটি দৃশ্য হয়ে উঠেছে আরও জীবন্ত।