স্বপ্নকন্যাদের বয়স নাকি ফ্রেমে বন্দি হয়ে যায়। ক্যালেন্ডার বা দিনের হিসেবে তা বেড়ে গেলেও মানসপটে তারা সেই রূপালী জগতের সোনালি অধ্যায়। স্বপ্নকন্যাদের কথা ভাবলেই যাদের নাম মাথায় খেলে যায়, তার মাঝে অন্যতম সুবর্ণা মুস্তাফা। জেমসের গানে যেমন বলা হয়েছে, ‘এই চোখে তাকিও না তুমি লুটপাট হয়ে যাবে’, ঠিক তেমনই তার চোখ। তার কণ্ঠ মানেই আবৃত্তির ষোলকলা পূর্ণ। আর অভিনয় যেন চিরচেনা মেয়েটির মুখে নানা বর্ণের রূপ। ঠিক নিজের নামের মতো।
সূবর্ণা মুস্তাফা পাঁচ দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ারে কাজ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন। বিশেষ করে যেটাকে ভিনদেশি ভাষায় বলে ‘ক্লাস্টার ব্রেকিং’ আর বাংলায় ‘গতানুগতিক ধারা‘র বাইরে গিয়ে কাজ করা, সেই কাজে বারবার তিনি রেখেছেন নিজের বৈশিষ্ট্যের ছাপ।
নিজের জীবনের হোক বা কাজের, একটা সময় সুবর্ণা মানেই ছিল পর্দায় ভিন্ন চরিত্র। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে দর্শকের কাছে ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকের মাধ্যমে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বহুল জনপ্রিয় এই নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটির জন্য বিপ্লব ঘটে যায় শহরের আনাচে কানাচে। চরিত্রটির যেন ফাঁসি না হয়, তার জন্য রাষ্ট্র প্রধানের কাছ থেকে ফোন কলও গেছে লেখক হুমায়ুন আহমেদের কাছে। সেই নাটকেরই মূল চরিত্র মুনা। আর মুনাই সুবর্ণা মুস্তাফা।
এই নাটকে পাড়ার বখাটে মাস্তান বাকের অর্থ্যাৎ আসাদুজ্জামান নূরের সাথে তার বায়বীয় আবেগী সংযোগ দর্শকের মনে দাগ কাটে গভীরভাবে। সেই দাগ এখনও মিটে যায়নি। যেখানে নায়ক বা নায়িকা মানেই সমাজের প্রচলিত ‘ভালো’ মানুষ, সেখানে মাস্তানের প্রেমে পড়া একটু ভিন্ন রকমই বটে। নাটকে বারবার কারাগারে যাওয়া, ফাঁসির পর দেহের জন্য আকুল অপেক্ষার সেই প্রেম আজও ইতিহাস বাংলাদেশের মিডিয়ার পাতায়। আর ভিন্ন ধর্মী প্রেমিকার চরিত্রের ‘মুনা’ এই সুবর্ণা।
একইভাবে ভিন্ন ধরনের প্রেম নিয়ে ফের পর্দায় আসেন সুবর্ণা ‘আজ রবিবার’ নাটকে। জাহিদ হাসানের আনিস চরিত্রের ‘হিজিবিজি হিজিবিজি’, শিলা আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের কঙ্কা-তিতলির জুটি ছাপিয়ে মীরা ও জামিলের মানবিক প্রেম অনেকটাই সফল হয় এই নাটকের মাধ্যমে। ফের হুমায়ুন আহমেদের লেখার কারিশমাতে অন্য রকম প্রেম দেখা যায় ১৯৯৬ সালে প্রচারিত হওয়া এই ধারাবাহিকে। যেখানে দুই টিনএজার কন্যার পিতা প্রেমে পড়েন মীরা নামের এক যুবতীর। তারা প্রণয়ের পথেও এগিয়ে যান। সে পথে আরও বুঝেশুনে এগোতে বাড়ির দেখভাল করার জন্য মীরাকে নিয়ে আসেন বাড়িতে। শুরু হয় মজার ঘটনার সাথে নাটকের বিভিন্ন বাঁকের মিশেল। এই নাটকে স্থপতি জামিলের চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল হায়াৎ।
ভিন্নধর্মী চরিত্র বলতে যা বোঝায়, এই নাটকে মীরা চরিত্রটি সেটিই। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেই পুরুষের সাথে প্রেম, তার দুই সন্তানকে আপন করে নেওয়ার প্রচেষ্টা, প্রেমিকের ভাই ও বাবাকে বোঝার চেষ্টা— সব মিলিয়ে মীরা চরিত্রটি একই অঙ্গে অনেক রূপ। আবার সামাজিক প্রথাগত চিন্তার বিপরীতে টেলিভিশনে এমন চরিত্রে অভিনয় করাও কম সাহসের নয় সেই সময়ে। সব পেছনে ফেলে মীরা হয়ে ওঠেন সমাজের পরিবর্তনের সেই ছবি যার মন ও মানসিকতা স্বাধীনভাবে সীদ্ধান্ত নিতে নারীদের উদ্বুদ্ধ করে।
সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত আরেকটি চরিত্র ভুলে গেলে চলবেই না। তা হলো ‘পালাবি কোথায়’ সিনেমার শিরিনের চরিত্র। এটিকে বাংলা সিনেমার ‘আন্ডাররেটেড’ সিনেমা বলা যেতে পারে। এখানে হাস্যরসের মাধ্যমে দপ্তরের যৌন হয়রানি ও তার সাজা নিয়ে গল্পটি সাজানো হয়। লম্পট বসের চরিত্রে অভিনয় করেন হুমায়ুর ফরিদী। আর শিরিনের চরিত্র এমন এক তরুণী যার ওপর পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা। শিরিন তার সকল সংশয় ও ভয় কাটিয়ে এক সময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন, লম্পট চরিত্রের বসের বিপরীতে গিয়ে অনেকটা প্রচলিত ধারাকে ছিন্ন করে। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত সিনেমাটি আদতে ফ্লপ হলেও এর গল্প ও চিত্রনাট্য সবসময়ের জন্য সমসাময়িক। এতে সুবর্ণা মুস্তাফার সাথে আরও অভিনয় করেছেন শাবানা ও চম্পা। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে।
শেকল ভাঙার গানে সুবর্ণা মুস্তাফার আরেকটি স্বরলিপি তার প্রথম সিনেমা। আর তা হলো সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘ঘুড্ডি’। এই সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সুবর্ণা। এই সিনেমায় সেই কালজয়ী ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি আছে, যার আবেদন এতো দশক পরও একটুও কমেনি। হ্যাপি আকন্দের এই গানে রাইসুল ইসলাম আসাদের পেটানো শরীর আর শিফন শাড়িতে সুবর্ণার সাগরপাড়ের হেঁটে চলা বলিউডের যেকোনো শিফন শাড়ির উপস্থাপনকেই যেন হার মানায়। সে সময়ের প্রেমিকদের মন আর প্রেম বুঝে নিজেকে অভিমানে সরিয়ে ফের নীড়ে ফেরার চরিত্রে তরুণী সুবর্ণা অনন্য সবসময়ের জন্য। এই সেই সিনেমা যেটিতে আগে থেকে সংলাপ বা চিত্রনাট্য তৈরি ছিল না। পরিচালক ততক্ষণাৎ সেটে তৈরি করেছেন। আর ইতিহাস বনে গেছেন।
সুবর্ণা মুস্তাফার অসংখ্য ভিন্নধর্মী কাজের ভিড়ে আরেকটি বৃত্তের বাইরের কাজ ‘গণ্ডি’ সিনেমাটি। ফাখরুল আরেফীন খান পরিচালিত সিনেমাটিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার পরিণতি নিয়ে তৈরি করা এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুবর্ণা। তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী। ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। প্রেমের কোনো বয়স নেই, সীমা নেই বা নেই লক্ষণরেখা— এই ধরনের চিত্রনাট্যে সুবর্ণা যেন অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ করে, সকল বয়সেই যে বেঁচে থাকার প্রেরণা প্রেম— তা এই সিনেমার মাধ্যমেই তুলে ধরেন সুবর্ণা-সব্যসাচী জুটি। বরাবরের মতোই সুবর্ণার এই প্রেমময় চরিত্রটিও দর্শকের মনে গেঁথে গেছে।
এভাবেই পর্দায় সুবর্ণা মানেই প্রেম হলেও সেই প্রেমের আছে একেক রূপ। সব প্রেমই যে মানুষের জীবনে শুধু প্রেমেরই মতো, কোনো প্রেম যে ব্যতিক্রম নয়, তা এই শিল্পী ছাড়া খুব কম শিল্পীর চরিত্রে খুঁজে পাওয়া যায়। বাস্তব জীবনেও তিনি প্রেমকেই গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজ, শেকল বা প্রথার বাইরে গিয়ে। এজন্যই সুবর্ণা মুস্তাফা কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি সেই দার্শনিক, যার জীবন থেকে শিল্প— একই দর্শন বয়ে চলে।
আর তাকে নিয়ে নোভার সেই গানটি গাওয়াই যায়, বর্ণে বর্ণে সুবর্ণা তুমি- একটি মাধবী রাত।