আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারেও লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন অলংকার ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা সংকটে বিক্রি কমেছে আশঙ্কজনক হারে। দেশের জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।
২০২৩ সালের শুরুতে সবচেয়ে ভালো মানের ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। গত ২২ মাসে দাম বেড়েছে ৫৩ হাজার ৫৩৮ টাকা। গত ১ জানুয়ারি প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা। শুধু চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সোনার দাম ভরিতে বেড়েছে ৩০ হাজার ৯১০ টাকা।
দেশের বাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধির আসল কারণ বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবান এই ধাতুর মূল্যবৃদ্ধি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সোনার দাম দফায় দফায় বাড়ছে। এক মাস আগে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম বিশ্ববাজারে প্রথমবারের মতো আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ৭০০ ডলারের ছাড়িয়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম
দেশের বাজারে সোনার দাম গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) আরও এক দফায় প্রতি ভরিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৯০ টাকা বেড়েছে। ভালো মানের তথা ২২ ক্যারেটের হলমার্ক করা এক ভরি সোনার দাম দাঁডিয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকা। এটিই দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সোনার সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যানুযায়ী, হলমার্ক করা ২২ ক্যারেট সোনার ভরি ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির পর হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২১ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫০১ টাকা ও ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ১৬ হাজার ১৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ৯৫ হাজার ৪২৩ টাকায়। ১৯৭২ সালে সোনার ভরি ছিল ১৭০ টাকা। আর এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৫১ টাকা। তার মানে গত ৫২ বছরে দাম বেড়েছে ৮৩৫ গুণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামে অস্থিরতা
সোনার দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে সুদিন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সোনার দাম বাড়তে থাকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। তখন পর্যন্ত ওই দামই ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। গত বছরের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সোনার দাম ২ হাজার ডলারের মধ্যেই ছিল।
গত বছর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর সোনার দাম আবার বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশেও উত্তেজনা ছড়ায়। গত সপ্তাহে লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সর্বশক্তি দিয়ে লেবাননে হামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় চলতি মাসেই প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়েছে পৌনে ২০০ ডলার।
বিশ্ববাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার হ্রাসেরও ভূমিকা আছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট কমায়। ফলে সোনা কেনার দিকে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক আরও বেড়ে যায়।
দেশে বেচাকেনা ব্যাপক কমেছে
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাশাপাশি সোনার দামও পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে । সোনার অলংকার এখন সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গয়না বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ছোট ও হালকা ওজনের গয়না তুলনামূলক বেশি বিক্রি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে লেনদেন বেশি হলেও আগের চেয়ে পরিমাণের দিক থেকে সোনার গয়নার বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দুই মাস ধরে সব খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ। তার প্রভাব জুয়েলারি খাতেও ব্যাপকভাবে পড়েছে।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সব ধরনের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে সোনার দামও বেশি বেড়েছে। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় জুয়েলারি ব্যবসায় সেই প্রভাব কিছুটা বেশি। গত দুই মাসে সোনার অলংকারের বেচাবিক্রি গড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।