দেশে গত ১৫ বছরে নজিরবিহীন আর্থিক কেলেঙ্কারি ও লুটপাটের অন্যতম মূলহোতা সালমান এফ রহমান। শেয়ার বাজার ও ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারির ‘মাস্টারমাইন্ড’ মনে করা হয় তাকে। কিভাবে ক্ষমতার জোরে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হওয়া যায়, তা এ দেশের ব্যবসায়ীদের শিখিয়েছেন সালমান এফ রহমান। এজন্য বিশ্লেষকরা তাকে বাংলাদেশের ‘ঋণখেলাপির জনক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তার মোট খেলাপি ঋণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। সালমান এফ রহমানকে বেনামি ঋণের জনকও বলা হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ছিলেন সালমান এফ রহমান, যিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ছিলেন। বর্তমানে তিনি পুলিশ হেফাজতে থাকা আসামি। সালমান ঢাকার দোহারের সংসদ সদস্য এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আইএফআইসি ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া অনেক ব্যবসায়ী সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদেও তিনি অধিষ্ঠিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
বিতর্কিত অধ্যায়ের শুরু যেভাবে
সালমান এফ রহমানের ঋণখেলাপি এবং ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারির ইতিহাস বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। আশির দশক থেকেই তিনি শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় তার নাম উঠে আসে। ২০০৭ সালে উইকিলিকস এর ফাঁস করা বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের একটি তারবার্তা প্রকাশ্যে আসে যাতে অভিযোগ করা হয় সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ঋণখেলাপি। ২০০৬-০৮ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের সময় ২০০৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি অপরাধ ও দুর্নীতির ১১টি মামলায় গ্রেফতার হন। ২০০৮ সালের ২০ আগস্ট হাইকোর্ট ব্যাংক জালিয়াতি মামলায় তাকে জামিন প্রদান করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে ফেলে।

২০১১ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি দাবি করে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সালমান এফ রহমানের ভূমিকা ছিল। কমিটি তাকে শেয়ারবাজার থেকে দূরে রাখার সুপারিশ করে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালার আওতায় বেক্সিমকো গ্রুপ বিশেষ সুবিধা পায়।
২০১৬ সালের আগস্টে, সোনালী ব্যাংক সালমান এফ রহমান ও তার ভাই আহমেদ সোহেল ফশিউর রহমানের (এ এস এফ রহমান) ধানমন্ডির বাড়ি নিলামে তোলার উদ্যোগ নেয়। এটি বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইনসের কাছে ২২৮ কোটি টাকা আদায়ের জন্য করা হয়েছিল। তবে নিলামের ঠিক আগের দিন এটি স্থগিত করা হয়। সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকে লুটপাট
জনতা ব্যাংকের বেশ পুরোনো গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রুপটি ১৯৭৮ সালে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৮ সালে গ্রুপটির পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। এরপর বেক্সিমকোর টেক্সটাইল, এলপিজি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগ্রাসী অর্থায়ন করে। ব্যাংকটির মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয় শাখা থেকে এই অর্থায়ন করা হয়, তখন শাখাটির ব্যবস্থাপক ছিলেন মিজানুর রহমান। তিনি এখন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।
জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে, দিয়েছে তার প্রায় ১৬ গুণ বেশি। যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকোর ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে জনতা ব্যাংকের ঋণের ৫০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাংকটি তারল্যসংকটে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে পণ্য রপ্তানি হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনতে হয়। আর তা না হলে অর্থ পাচার আইনে ওই রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বেক্সিমকোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ১২ বছর ধরে পণ্য রপ্তানি করে সেই আয় দেশে না আনা বড় ধরনের অনিয়ম ও অপরাধ। এর পেছনে অর্থ পাচারের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই। বিদেশ থেকে রপ্তানির অর্থ না আসার পরও জনতা ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে যেভাবে অর্থ দিয়ে গেছে, সেটি একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে বেক্সিমকো ও ব্যাংকের যারা যারা জড়িত, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। প্রয়োজনে বেক্সিমকোর সম্পদ বিক্রি করে হলেও অর্থ আদায়ে কার্যকর সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ
সরকারি-বেসরকারি আট ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ (নন-ফান্ডেডসহ) দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এসব ব্যাংক বেক্সিমকোর বন্ড ও সুকুকে আরও ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর বাইরে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বেক্সিমকোর দেনা রয়েছে বলে জানা গেছে, যা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুঁজে দেখছে। সুতরাং সালমান এফ রহমানের নেওয়া প্রকৃত ঋণ আরও অনেক বেশি। জানা গেছে, রাষ্ট্র খাতের সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও বেসরকারি খাতের এবি, এক্সিম, ন্যাশনাল, সিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, সাউথইস্ট, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকসহ আরও নানা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের দেনা রয়েছে।
শুধু জনতা ব্যাংকের এক শাখা থেকেই ঋণের নামে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন তিনি। যা ওই শাখার মোট ঋণের ৬৫ শতাংশ। এরই মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি হয়ে গেছে। এসব ঋণের অধিকাংশই ছিল বেনামি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে বেনামি ঋণগুলো তার নামে সংযুক্ত করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও জনতা ব্যাংকের নথি ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংকার জানান, বেনামি ঋণের জনক ছিলেন সালমান এফ রহমান। যা ধীরে ধীরে পুরো ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের বেশিরভাগ ঋণই বেনামি। এখন প্রায় সব অসাধু ব্যবসায়ীর বেনামি ঋণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে লুটপাটের বেশিরভাগই বেনামি ঋণ। অর্থাৎ ঋণ নেন একজন, ভোগ করেন অন্যজন। প্রকৃত সুবিধাভোগী থাকেন সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সব ধরনের বেনামি ঋণ খুঁজে বের করা। তা না হলে ব্যাংক খাত টিকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ এবং গ্রুপ সম্পর্কিত মোট ৩২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এছাড়া সুকুক বন্ডের নামে নেয়া হয় ২২০ কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশিরভাগই ২০২১, ২২ ও ২৩ সালে নেয়া। এর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস ৬০৯ কোটি, এ্যাপলো অ্যাপারেলস ৭৯৮ কোটি, অটামলুপ অ্যাপারেলস ৮২২ কোটি, বে সিটি অ্যাপারেলস ৮৯২ কোটি, বেক্সিমকো লিমিটেড ২ হাজার ২১৬ কোটি, বেক্সিমকো পিপিই ২৬ কোটি, বেক্সিমকো ফ্যাশনস ৯৩৬ কোটি, বেক্সটেক্স গার্মেন্টস ৮৮৫ কোটি, কসমোপলিটান অ্যাপারেলস ৯৬১ কোটি, কজি অ্যাপারেলস ৯০৬ কোটি, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন ১ হাজার ৬৯০ কোটি, এসকর্প অ্যাপারেলস ৮১৯ কোটি, অ্যাসেস ফ্যাশনস ১ হাজার ৭৫৮ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ১ হাজার ২৫০ কোটি।
ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ইউনিট-টু ৬৪৯ কোটি, কাঁচপুর অ্যাপারেলস ৭৫৯ কোটি, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস ৭৩২ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ৬৮৬ কোটি, পিয়ারলেস গার্মেন্টস ৯৬০ কোটি, পিংক মেকার অ্যাপারেলস ৯০২ কোটি, প্লাটিনাম গার্মেন্টস ৮৩৭ কোটি, শাইনপুকুর গার্মেন্টস ৩৩৩ কোটি, স্কাই নেট অ্যাপারেলস ৭৩৮ কোটি, স্প্রিংফুল অ্যাপারেলস ৭৬০ কোটি, আরবান ফ্যাশনস ৭০৪ কোটি, হোয়াইট বে অ্যাপারেলস ৮৮৫ কোটি, ইউন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস ৭৭২ কোটি, ইয়োলো অ্যাপারেলস ১ হাজার ৫০ কোটি, ক্রিসেন্ট অ্যাকসেসরিজ ৯৬ কোটি, আর আর ওয়াশিং ৯৭ কোটি, এসকর্প এলপিজি ১১ কোটি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বেনামি প্রতিষ্ঠান ছিল। পরে এগুলোকে বেক্সিমকো গ্রুপভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিভিন্ন হারে জামানত রেখে একজন গ্রাহক ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন। সালমান এফ রহমানের ক্ষেত্রে সেসবের কিছুই মানা হয়নি। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণ নিয়েছেন তিনি। তাকে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। আবার পরিচালনা পর্ষদ এবং এমডির নির্দেশনা থাকলে অনেক সময় কর্মকর্তাদেরও কিছু করার থাকে না।
বিপুল অঙ্কের এসব ঋণ নেয়ার সময় জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি অর্থ সচিব থেকে গভর্নর থাকা পর্যন্ত পুরোটা সময় আব্দুছ ছালাম আজাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যে কারণে আব্দুছ ছালাম আজাদকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির।
পণ্য রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার
বেক্সিমকোর ১৭টি প্রতিষ্ঠান দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে পোশাক রপ্তানি করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, দুবাইয়ের যে প্রতিষ্ঠানে বেক্সিমকো পোশাক রপ্তানি দেখিয়েছে, সেটি সালমান এফ রহমানের পরিবারের। কেবল পোশাক রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৮ কোটি মার্কিন ডলার পাচার করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ, যা বর্তমান বাজারমূল্যে ৯৫৭ কোটি টাকার সমান।
বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান তার ভাই সালমান এফ রহমান। দুবাইয়ে আর আর গ্লোবালের মূল প্রতিষ্ঠান আর আর হোল্ডিংসের প্রতিষ্ঠাতা সোহেল রহমানের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমান ও সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমান। দুবাইয়ের আল গারহৌদ এলাকার জালফা বিল্ডিংয়ের ঠিকানায় আর আর হোল্ডিংসের নিবন্ধন হয়। ৫ আগস্টের আগে আর আর হোল্ডিংসের ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির নানা ব্যবসার ও প্রতিষ্ঠাতাদের তথ্য দেওয়া ছিল। পরে প্রতিষ্ঠাতাসহ কিছু তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি তেল-গ্যাস, পোশাকসহ নানা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে সেখানে উল্লেখ আছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, পোশাক রপ্তানি ছাড়াও বেক্সিমকো গ্রুপ গত ১৫ বছরে জনতা ব্যাংকসহ ৭টি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। এ ছাড়া নামে-বেনামে আইএফআইসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক থেকেও একই কায়দায় ঋণ নিয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি গত তিন বছরে বন্ডের নামে বাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া আরও ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, বেক্সিমকো গ্রুপ সৌদি আরবের দাম্মামে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল গড়ে তুলেছে। যার পুরো অর্থ দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রুপটির বিরুদ্ধে পোশাক রপ্তানির বাইরে বাণিজ্যের আড়ালে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে সিআইডি।
আরও যত কেলেঙ্কারি
সালমানের বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে ব্যাংকটিকে ঝুঁকিতে ফেলেছিল। সেই ঋণের পরিমাণ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে নয় গুণ বেশি। এটা তার বহু কাজের একটা উদাহরণ মাত্র।
১৯৭২ সালে কমোডিটি ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে সালমান ও তার বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো বিভিন্ন সময় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার জন্য নতুন নিয়ম তৈরি বা সংশোধন করতে নিয়ন্ত্রকদের বাধ্য করেছেন। এর মাধ্যমে আদালতের আদেশের বিপরীতে নিজেকে সুরক্ষিত করেছিলেন তিনি।
২০১৪ সালের আগস্টে তারল্য সংকটের কারণ দেখিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া বেক্সিমকোর ঋণ পুনঃতফসিল করেন সালমান এফ রহমান। এর পেছনে কোম্পানিটি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিনিষেধ, পূর্ববর্তী তিন বছরে ৮০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ এবং ২০১৩-১৪ সালে দীর্ঘ অবরোধ ও শাটডাউনের কারণে ঘটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে দায়ী করেন। ওই সময় সাতটি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া এক চিঠিতে বেক্সিমকো টিকে থাকতে জরুরি ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের আহ্বান জানিয়েছিল।
২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন বড় ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করে, যার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণগ্রহীতাদের আবেদন গ্রহণ করে।
প্রায় ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ওই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের খেলাপি ঋণের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে। সেই সময় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এই অর্থের এক-তৃতীয়াংশই পুনর্গঠন করেছে বেক্সিমকো। ঋণগ্রহীতাদের স্বাভাবিক ১০ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র ১-২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এবং সর্বোচ্চ ১২ বছরের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দেওয়া হয়। নীতিমালায় কোনো ঋণগ্রহীতা পরপর দুই কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংকগুলোকে এ সুবিধা প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতারা ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতে যে বেক্সিমকো বিচলিত হয়নি, সেটা তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়।
নীতিমালার আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ১২ বছর মেয়াদে ১০ শতাংশ সুদে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকোর এক হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে, যা তখনকার ১৩-১৪ শতাংশ সুদের হারের চেয়ে অনেক কম।
এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ঋণগ্রহীতার প্রতি প্রান্তিকে সোনালী ব্যাংককে ৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঋণগ্রহীতার ছয় কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেক্সিমকো দিয়েছে মাত্র দুটি কিস্তি। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে তা খেলাপিতে পরিণত হয়। এরপরেও সোনালী ব্যাংক প্রদত্ত সুবিধা প্রত্যাহার করেনি এবং বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে মামলাও করেনি। এর পরিবর্তে ২০১৮ সালের মার্চে আবারও বেক্সিমকোকে দেওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য খেলাপি ঋণের ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট বাধ্যতামূলক হলেও তা করতে বেক্সিমকোকে কোনো ডাউন পেমেন্ট করতে হবে না।
আরেকটি উদাহরণ হলো জিএমজি এয়ারলাইনসের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য ২০১৬ সালের আগস্টে সালমান ও তার ভাই সোহেলের সম্পত্তি নিলামে তোলার জন্য সোনালী ব্যাংকের উদ্যোগ বন্ধ করা। ২০০৯ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজির অর্ধেক শেয়ার কিনে নেয় বেক্সিমকো। গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলার নোটিশ দিলে জিএমজি হাইকোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেয়। বছরের পর বছর ধরে গ্রাউন্ডেড থাকা বিমান সংস্থাটিও আদালতের আদেশের কারণে তার অ্যাকাউন্টগুলো নিয়মিত রাখতে সক্ষম হয়।
সালমানে বিধ্বস্ত ডিবেঞ্চার মার্কেট
নব্বইয়ের দশকে সংগৃহীত প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করায় বাংলাদেশের ঋণপত্র বাজার ধ্বংস করার অভিযোগ এখনো রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। ডিবেঞ্চার এক ধরনের ঋণ বিন্যাস, যা বৃহৎ কোম্পানিগুলো অর্থ ধার করার জন্য ব্যবহার করে। বেক্সিমকো ১৯৯৪-৯৫ সালে ১০ বছর মেয়াদে চারটি ডিবেঞ্চার ইস্যু করে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। ওই বছর তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য সুকুক ইস্যু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বেক্সিমকো। এ অবস্থায় বেক্সিমকোর ঋণখেলাপি ইস্যু সমালোচনার মুখে পড়ে এবং কোম্পানিটিকে পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। নির্ধারিত সময়ের ১৫ বছর পর ওই টাকা পরিশোধ করেছে সংস্থাটি।
বন্ড বিক্রির জন্য রাজনৈতিক সুবিধা ব্যবহার
সালমানের বেক্সিমকো ২০২১ সালে দেশের সবচেয়ে বড় সুকুক ইস্যু করে, যার মাধ্যমে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করে। তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বন্ড বিক্রির জন্য তার রাজনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করেছিলেন। কোনো ব্যাংক ও নন-ব্যাংক এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। সালমান তার সুকুকে বিনিয়োগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চাপ দেন। তা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংক স্বল্প পরিমাণ তহবিল বিনিয়োগ করেছে। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে অন্তত দুইবার বিনিয়োগের সময় বাড়াতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে তার সুকুকে বিনিয়োগ করতে পারে, সেজন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা পরিবর্তন করেছেন।
পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি তহবিল গঠন করে এবং ব্যাংকগুলোকে শুধু শেয়ারবাজারের জন্য পরিকল্পিত তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। সালমান এফ রহমান ব্যাংকগুলোকে সুকুকে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেন। এরপর সালমান কয়েকটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার কোম্পানির সুকুকে বিনিয়োগ করতে বলেন।