আমাদের দেশে মূলত আশি ও নব্বই দশক থেকে অর্থ পাচার শুরু হয়। পরবর্তীকালে প্রায় সব সরকারের আমলেই তা কমবেশি বিস্তৃতি লাভ করে। তবে গত ১৫ বছরে অর্থ পাচার সব রেকর্ড ছডিয়ে গেছে। এ সময় কয়েক লাখ কোটি টাকার বেশি দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অপরিকল্পিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণেই পাচারকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে অর্থ পাচারে। ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস, হুন্ডি ও দিপাক্ষিক চুক্তির কমিশন বাণিজ্যর মাধ্যমে দেদার অর্থ পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা হলেও, কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার বিষয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে
অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার পাশাপাশি পাচারকৃত টাকার অংকও বেড়েছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ বা কত টাকা পাচার হয়, তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। বিভিন্নরকম হিসেব-নিকেশের ভিত্তিতে অনুমিত কিছু সংখ্যা মেলে। যেমন: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরার সময় বলেছিলেন যে, ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। সে হিসেবে গড় বছরে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে। আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই)-র পরিসংখ্যান দেখায় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-২০১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। মানে, বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রপ্তানিতে কম দর দেখিয়ে। যেহেতু টাকা পাচার পরিমাপের কোনো সার্বজনীন পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি নেই, সেহেতু বিভিন্ন সূচকে বিভিন্ন রকম সংখ্যা মেলে।
যেভাবে টাকা পাচার হয়
টাকা পাচার বা পুঁজি পাচারের কোনো বৈশ্বিক অভিন্ন সংজ্ঞাও নেই। বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই পুঁজি একদেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। মুদ্রামানের পতনজনিত কারণে অনেক সময় দেশ থেকে টাকা বাইরে চলে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা ও পুঁজি নিজদেশে বৈধপথে প্রত্যাবাসন করে। আবার বৈধ উৎসে উপার্জিত আয় অবৈধপথে কিংবা কর ফাঁকি দেয়া অর্থ বৈধপথে বিদেশে যেতে পারে। তবে বৈধপথে বিদেশে যাওয়া টাকা অনেকটা সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় দলিল-দস্তাবেজ থাকার কারণে। আর এটা টাকা পাচার হিসেবে অভিহিত করা যায় না, যদিও দেশ থেকে পুঁজি বাইরে চলে যায়। ধারণাগত অস্পষ্টতা ও তথ্যগত অপ্রতুলতার কারণেও টাকা পাচারের বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। যেমন: সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের বা বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট গচ্ছিত অর্থের পুরোটাই এদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা নয়। তারপরও ঢালাওভাবে এটা বলা হয়ে থাকে। ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ ( প্রায় ৬৭০ কোটি টাকা), যা ২০২১ সালে ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। আবার প্রায় দু’ বছর আগে কয়েকটি পত্রিকা ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, বিদেশি বাংলাদেশিদের অবৈধ বিনিয়োগ অনুমোদিত বিনিয়োগের নয় গুণ বেশি, যার পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ৩৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে ঐ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বৈধভাবে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল প্রায় ৩৯ কোটি ডলার।
কেউ কেউ অবশ্য এটাও মনে করেন যে, বিদেশে বিনিয়োগ করার আড়ালে আসলে টাকা পাচার হচ্ছে, যদিও তা প্রমাণ করা খুব কঠিন। যেমন: গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর আলোচ্য অর্থবছরে বিদেশে বাংলাদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল তিন কোটি ২২ লাখ ডলার। এই অর্থ যেহেতু সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে গেছে, সেহেতু এটাকে পাচার বলার কোনো উপায় নেই। বরং, যেটা জানা প্রয়োজন, তা হলো এসব বিনিয়োগের বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে দেশে কতটুকু অর্থ মুনাফা হিসেবে প্রত্যাবাসিত হয়েছে।

পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ
বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে, আমদানির ঘোষণায় যে পণ্য দেশে আসার কথা, তা না এনে প্রকৃতপক্ষে অন্য পণ্য আনা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিদেশি রপ্তানিকারকের তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তারা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের তথ্যের সঠিকতা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস তথ্য সরবরাহ করলে তা তদন্তে সহায়ক হবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতামুলক দামের কোন তথ্যভান্ডার না থাকায় – বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব।
বিএফআইইউ বলেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের সঙ্গে যোগসাজশে বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে বিদেশে অর্থপাচারের অপরাধে অভিযুক্তরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং এসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে।
ওভার-ইনভয়েস ও আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে আরো বলা হয়, রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন কর না থাকা এবং কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শূন্য শুল্কহার থাকায় কাস্টমস কর্মকর্তারা রপ্তানি চালান যাচাইয়ে কম মনোযোগী হন। পাচারকারীরা এই সুবিধাটিই বেশি গ্রহণ করছে।
অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী বিদেশে সন্তানের লেখাপড়ার আড়ালে অর্থপাচার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কিনছেন বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামলার বিষয়বস্তুর সম্পর্কে অনেক সময়েই অভিজ্ঞ থাকেন না।
অর্থ ফেরত আনার সাফল্য যৎসামান্য
ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। কিন্তু পাচার হওযা অর্থ উদ্ধারে সরকারের তেমন কোন সফলতা নেই।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গত অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছিলো সরকার। কিন্তু পুরো বছরজুড়ে একজন পাচারকারীও অর্থ ফেরত আনেনি। সে তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অফশোর ভলানটারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রামের আওতায় ৪৫ হাজার করদাতার কাছ থেকে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কর, জরিমানা ও সুদ আদায় করেছে বলে উল্লেখ করেছে বিএফআইইউ।
সুইস ব্যাংকে গোপন হিসাব রয়েছে এমন করদাতাদের কাছ থেকে ফ্রান্স ১২০ কোটি ইউরো ও ইতালি ৫৭ কোটি ইউরো ফাঁকি দেওয়া কর ও জরিমানা আদায় করেছে। একই তথ্যের ভিত্তিতে, যুক্তরাজ্য ১৫ কোটি পাউন্ড ও স্পেন ২১ কোটি ইউরো আদায় করেছে।
সুইস ও লিখটেনস্টেইন ব্যাংকের গোপন হিসাবের তথ্য অন্য এক হুইসেলব্লোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে জার্মানি ২০১০ সালে ১৬০ কোটি ইউরো কর পুনরুদ্ধার করেছে।

পাচার হওয়া অর্থ কিভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফএফআই) তথ্য মতে, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা দীর্ঘ ও জটিল বিষয়। তিনি বলেন, এর সফলতার হার খুবই কম। বিশ্বজুড়ে ৩/৪ শতাংশ বলে অনেকে দাবি করে থাকেন।
বিএফএফআই জানায়, অর্থপাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে এবং তিনি যেখানে পাচার করেছেন সেখান থেকে যে কোনো মাধ্যমে সঠিক তথ্যটি পেতে হবে।
পাচার যে দেশে হয়েছে সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দু দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পারিক তথ্য বিনিময় করবে। কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সের অনুরোধ করতে হয়। সেটা দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের মতো করে তথ্য আনতে হয়।
বিএফএফআই তথ্য মতে, ওই অনুরোধের পর পাওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয় এবং সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে সেখানকার আদালতেও ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয়। এ পর্যায় পর্যন্ত গেলে পাচার করা অর্থ আনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে এরপরেও দু দেশের মধ্যে সমঝোতা ও কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয় আছে।
বিএফএফআই বলছে, যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে সেটি আদালত পর্যন্ত এলে তারপর ওই দেশ সহযোগিতা করলে টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এজন্য জাতিসংঘ কনভেনশনের আওতায় কিছু পথ আছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সাথে ৭২ দেশের এফআইইউ-এর সমঝোতা আছে। এছাড়া এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৬৫ টি দেশের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। আবার ট্যাক্স রিকভারির জন্য রাজস্ব বোর্ডের কিছু চুক্তি আছে।
সবকিছু কাজে লাগিয়ে দেশের আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় পেলে তা যে দেশে পাচার হয়েছে সেদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে পাঠানো হয়। ওই অর্থ ফেরত দেয়া যায় কিনা সেটি নিয়ে তারা সেখানে মামলা করতে পারে এবং এরপর ওই দেশ অর্থ ফেরত দিতে কোনো আইনি সমস্যা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে।

যদি পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকে, সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর এসব কারণেই বিষয়টি অনিশ্চিত , জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী।
পাচার হওয়া অর্থ মামলা ছাড়া ফেরত আনা সম্ভব?
এটি সম্ভব, যদি উভয় দেশে এ নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। বাংলাদেশ এই এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। এ ক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
এটি পাওয়ার পর ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে এবং তাতে কোনো তথ্যে গরমিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।
পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ শুরু
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। অর্থ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে ইতোমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। বিদেশে পাচার করা হয়েছে সেই অর্থ। এর সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলছে। আত্মসাৎ করা এই অর্থের পরিমাণ লক্ষাধিক কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারা আরও জানায়, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার কাজে ইতোমধ্যে হাতে দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা হবে। নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা এসব অর্থের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তাদের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের লক্ষ্যে শুরু হবে অডিট কার্যক্রম।
ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহায়তা নিয়ে আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে।
ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক হিসেবে থাকবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এই টাস্কফোর্স।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা বড় ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের দেশে থাকা সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছি। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সামনে আরও আলোচনা হবে। আমরা তাদের কাছ থেকে অর্থ ফেরত আনতে ও কারিগরি সহায়তা দিতে আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা জব্দের জন্য বলছি।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যুক্তরাজ্যেই শুধু একজনের ৫০০-৬০০ বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। আরও অনেকের এমন সম্পদ রয়েছে। আমাদের অর্থের বড় গন্তব্য যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব অর্থ ফেরাতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়।’
পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনার বিকল্প পথ
প্রথমত, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ওপর সরকারিভাবে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে। কাজেই পাচার হওয়া টাকার কিছু যদি এই রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আনা হয়, তাহলে উল্টো বাড়তি কিছু লাভ জুটবে। আর একেবারেই কেউ যে এই সুযোগ কিছুটা হলেও কাজে লাগায়নি, তা জোর দিয়ে বলা যায় না, যদিও এর সমর্থনে কোনো উপাত্ত নেই।

দ্বিতীয়ত, বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবেও পাচার হওয়া টাকার কিছু অংশ ফিরে আসার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের উৎস নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন করা হয় না। ফলে বারমুডা, মরিশাস, সিশেলস ও পানামার মতো অফশোর জুরিসডিকশন বা ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসে থাকে, তার মধ্যে যে পাচার হওয়া টাকা নেই, তা কেই বা নিশ্চিত করে বলতে পারে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এরকম ১৫টি দেশে থেকে নিট বা প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, গত এক দশকে এরকম বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৯ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। যেমন, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে সার্বিক নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার যেখানে উল্লিখিত ১৫টি দেশ থেকে এসেছিল প্রায় ৯ কোটি ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট ৩২৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে ৬১ কোটি ডলার বা ১৯ শতাংশ এসেছে ১৫টি দেশ থেকে। তবে এই ১৫টি দেশের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুর থেকেই অর্ধেক বিনিয়োগ আসে। এসব বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে দেশ থেকে পাচার হওয়া কিছু অর্থ রয়েছে। পাচারকারীরা কেউ কেউ পানামা, কেম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর জুরিসডিকশনে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বেনামী কোম্পানি খুলেছে। তারপর সেই কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ দেখিয়ে সেই টাকার কিছুটা ফেরত এনেছে। এতে লাভ হলো যে, বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন সুবিধা নেয়া। এভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনাকে বলা হয় রাউন্ড ট্রিপিং বা ঘুরপথে বিনিয়োগ। ভারতে মরিশাস থেকে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তার সিংহভাগ এভাবে আসে বলে এখন এই বিনিয়োগের ওপর করারোপ করা হয়েছে।
পাচারের অর্থ উদ্ধারে নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতোমধ্যে চুক্তির খসড়া কপি দেশগুলোতে পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড এবং হংকং-চীন। এসব দেশেই বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার করে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের কাছ থেকে চুক্তির খসড়া কপি পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া আরও কিছু তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এছাড়া, হংকং কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের কাছে তিনটি খসড়া চুক্তির কপি পাঠিয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ পর্যালোচনা করছে। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে পারস্পরিক সহায়তার জন্য সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন গ্লোব নেটওয়ার্ক নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য হয়েছে। এছাড়া, জননিরাপত্তা বিভাগকে অ্যাসেট রিকভারি ইন্টারএজেন্সি নেটওয়ার্ক এশিয়া প্যাসিফিক (এআরআইএন- এপি)-র সদস্য হতে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গ্লোব নেটওয়ার্ক অ্যান্ড গ্লোবাল ফোরাম অন ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ইনফরমেশন ফর ট্যাক্স পারপাস- এর সদস্যপদ নেবে বলে জানা গেছে।
মূলত অর্থনীতির আকার যত বাড়ে, তত টাকা পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে, যদি দেশে সুশাসনের ঘাটতি থাকে, আর্থিকখাতে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া হয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে শৈথিল্য দেখা যায়। আর যারা টাকা বাইরে পাচার করেন, তারা সাধারণত তা ফেরত নিয়ে আসার প্রত্যাশা করেন না। ফলে, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রচেষ্টা বেশ দুঃসাধ্য। তবে যথাযথভাবে ব্যবস্থা নিলে কিছু অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।