Home বাণিজ্য শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান পারলেও বাংলাদেশ পারেনি

শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান পারলেও বাংলাদেশ পারেনি

ইকবাল হোসেন
৫৫ views

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশ পারেনি। বরং বাংলাদেশের জন্য মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কাও ভোক্তা মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।

পাকিস্তানের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত দেশও মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশে। বাংলাদেশে তখন ১০ শতাংশের নিচে, ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অবিশ্বাস্য তথ্য হচ্ছে—সেই শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক (-), আর বাংলাদেশে বাড়তে বাড়তে ১১-১২ শতাংশের ঘরে ঘোরাফেরা করছে।

আর এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। বিপরীতে বাংলাদেশে সংকট ঘনিয়ে আসছে। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততোই বাড়ছ। এই দুই বছরে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা রুপির দরবৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কমানো হয়েছে, তার হাত ধরে মূল্যস্ফীতির এই অধঃগতি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ঋণাত্মক থাকতে পারে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, গত চার মাস ধরে দেশটিতে কোনো মূল্যস্ফীতি হচ্ছে না; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ নেগেটিভ (-) মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।

ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে গত আগস্টে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে তা মাইনাস শূন্য দশমিক ২ (-০.২) শতাংশে নামে। অক্টোবর ও নভেম্বরে এই হার ছিল মাইনাস শূন্য দশমিক ৭ (-০.৭) ও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ। সবশেষ ডিসেম্বরেও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে শ্রীলঙ্কায়।

অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমছে না; কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেজনক সূচক মূল্যস্ফীতি কমবে-কমবে বলে বার বার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে নাজেহাল পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতিও নিম্মমুখী হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে দেশটির মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশে উঠেছিল।  সে বছর সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছিল। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নেমে আসে। ডিসেস্বরে সেই মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান নয়, বিশ্বের সব দেশের মূল্যস্ফীতির পারদই কমছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে। এর পরও তিনি একাধিকবার একই কথা বলেছেন। পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে; কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। সরকারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্য পূরণ হবে না। গত শুক্রবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি (২০২৫) সংস্করণে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপে ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে।

“বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া।”

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত ; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “আমাদের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে পারছি না।”

“প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। তিনি হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, মূল বিষয় হলো চাহিদা ও সরবরাহ। কিন্তু দেশে কত চাহিদা আছে আর কত সরবরাহ হচ্ছে, সেই হিসাব নেই। অনেক সময় কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মেলে না। বাজারে কখন ঘাটতি হতে পারে, সেই বার্তা আগেভাগেই আমদানিকারকদের দিতে হবে। সেই সঙ্গে এসব আমদানির জন্য দ্রুত এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্থায়ী কমিশন আছে, যারা সবসময় বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ের স্বার্থই রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের সে রকম কিছু নেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথেষ্ট পরিমাণে সময়মতো আমদানি করে, তাহলে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় থাকবে। সে জন্য তাদের আরও বেশি পণ্য আমদানি করা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। মূল বিষয়য় হলো, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিমভাবে ভারসাম্যহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সমস্যা হলো, এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ