দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবিত্ত ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে প্রাইজবন্ড বেশ জনপ্রিয়। মাত্র ১০০ টাকার প্রাইজবন্ড কিনে সর্বোচ্চ ৬ লাখ টাকাসহ নানা অর্থ পুরস্কার জেতার সুযোগ থাকায় এটি অনেকের কাছে আকর্ষণীয় একটি বিনিয়োগ মাধ্যম। আর পুরস্কার না জিতলেও যেকোনো সময়ে প্রাইজবন্ড ভাঙিয়ে সমমূল্যের টাকা সরকারি/বেসরকারি ব্যাংক অথবা পোস্ট অফিস থেকে তোলা যায়।
প্রাইজবন্ড কী?
প্রাইজবন্ড হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত একটি বিনিয়োগ প্রকল্প। বিনিয়োগকারী যে কোনো সময় প্রাইজবন্ড কিনতে পারেন এবং প্রয়োজনে তা ভেঙে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে পারেন। এই প্রকল্পে সুদ বা মুনাফা প্রদান করা হয় না। তবে প্রতি তিন মাস অন্তর লটারির মাধ্যমে বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই স্কিম চালু করেছে। এটি জনগণের সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের জন্য একটি সহজ ঋণ সংগ্রহের মাধ্যম।
কেন কিনবেন?
প্রাইজবন্ডে কোনো ঝুঁকি নেই। এটি যে কোনো সময় ভাঙানো যায় এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য। ব্যাংকে সঞ্চয় করলে বা অন্য বিনিয়োগে মূলধন সহজে উত্তোলন করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রাইজবন্ড দিয়ে তাৎক্ষণিক নগদ অর্থ তোলা যায়।
কোথা থেকে কিনবেন
আপনার আশপাশের যেকোনো ব্যাংক বা ডাকঘর থেকে প্রাইজবন্ড কিনতে পারবেন। তবে বেসরকারি ব্যাংকের সব শাখায় হয়তো প্রাইজবন্ড না–ও পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমালিকানাধীন যেকোনো ব্যাংকে যেতে পারেন। যদি আপনি শহরের বাসিন্দা হন, তাহলে নাহয় ব্যাংক থেকে কিনলেন। যদি গ্রামে থাকেন, আর আপনার এলাকার আশপাশে কোনো ব্যাংক না থাকে, তাহলে কী করবেন? সে ক্ষেত্রে আপনার বাড়ির পাশের ডাকঘরে যেতে পারেন। যদি কোনো কারণে ওই ডাকঘরে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাইজবন্ড না পান, তাহলে তাদের আপনার চাহিদার কথা বলুন। তারা জোগাড় করে দেবে। একটা সময় দেশে বিয়েশাদি ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে প্রাইজবন্ডের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এখন সেভাবে না থাকলেও একেবারে যে এই চল উঠে গেছে তা নয়। কালেভদ্রে এখনো উপহার হিসেবে প্রাইজবন্ডের দেখা মেলে।
কখন ড্র হয়?
প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই ও ৩১ অক্টোবর। নির্ধারিত তারিখে সরকারি ছুটি থাকলে পরবর্তী কার্যদিবসে ড্র অনুষ্ঠিত হয়। তবে নতুন কেনা বন্ড দুই মাসের মধ্যে ড্রয়ের আওতায় আসে না। ড্রয়ের দিন যে বন্ডের মালিকানা থাকবে, সেই ব্যক্তি পুরস্কার জেতার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। ধরা যাক, আপনি ২৫ জানুয়ারি প্রাইজবন্ড কিনেছেন। তাহলে ৩১ জানুয়ারি যে ড্র অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে আপনার কেনা প্রাইজবন্ডটি লটারির ড্রয়ের জন্য বিবেচিত হবে না। জানুয়ারির পর ৩০ এপ্রিল যে ড্র হবে, সেখানে সেটি বিবেচনায় আসবে।
পুরস্কার কত টাকা?
তিন মাস অন্তর প্রাইজবন্ডের লটারির ড্র হয়। আপনার কেনা কোনো প্রাইজবন্ড যদি সেই লটারি জিতে যায়, আর সেটি যদি হয় প্রথম পুরস্কার, তাহলে তো আর কথায় নেই। প্রথম পুরস্কার হিসেবে পাবেন ৬ লাখ টাকা (১টি)। আর দ্বিতীয় পুরস্কারের অর্থমূল্য ৩ লাখ ২৫ হাজার (১টি), তৃতীয় পুরস্কার ১ লাখ টাকা (২টি), চতুর্থ পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা (২টি) এবং সর্বনিম্ন পুরস্কার ১০ হাজার টাকা (৪০টি)। প্রতি মাসে প্রাইজবন্ডে মোট ৪৬টি পুরস্কার রয়েছে। শুধু একটি সিরিজের জন্যই ৪৬টি পুরস্কার। এমন আরও ৭০টি সিরিজ রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাইজবন্ডে মোট পুরস্কারের সংখ্যা ৩ হাজার ২২০টি। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রাইজবন্ডের ড্রয়ের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
পুরস্কারের টাকা যেভাবে তুলবেন
পুরস্কারের টাকা তুলতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, ব্যাংক হিসাবের বিবরণ, নমিনি এবং প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা কর্তৃক শনাক্তকারী স্বাক্ষর লাগবে। ”ড্র” অনুষ্ঠানের দুই বছর পর্যন্ত পুরস্কারের টাকা দাবি করা যায়। এর মধ্যে কেউ দাবি না করলে পুরস্কারের অর্থ তামাদি হয়ে সরকারি কোষাগারে ফেরত যায়। পুরস্কার বিজয়ীরা বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো বা ডাকঘরে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে পুরস্কার নিতে পারেন। আর যদি প্রাইজবন্ডে পুরস্কার না পান, তবে যেকোনো সময়ে প্রাইজবন্ডের সমমূল্যের টাকা সরকারি/বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা পোস্ট অফিসেও ভাঙাতে পারবেন।
পুরস্কারে আছে কর
প্রাইজবন্ডের পুরস্কার কিন্তু করমুক্ত নয়। লটারিতে বিজয়ীর পুরস্কার মূল্য থেকে ২০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হয়। আপনি যদি প্রথম পুরস্কার ৬ লাখ টাকা বিজয়ী হন, তাহলে প্রতি লাখে উৎসে কর বাবদ ২০ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে। সে ক্ষেত্রে পুরস্কারের ৬ লাখ টাকার বিপরীতে আপনি হাতে পাবেন ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ফেরত পাবেন ১০০ টাকার প্রাইজবন্ডের মূল্যও। তবে পুরস্কারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে পুরস্কারের অর্থ দাবি করতে হবে। অন্যথায় পুরস্কারটি বাতিল হয়ে যাবে।
ড্রর ফল মেলানো যায় অনলাইনেই
প্রাইজবন্ড মেলানোর ডিজিটাল পদ্ধতি হাতের নাগালেই। অনলাইন ও অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই মেলাতে পারবেন প্রাইজবন্ডের ফল। ব্যস্ততার কারণে অনেকেই সংগ্রহে থাকা প্রাইজবন্ডের ড্রর ফল মেলানোর সময় পান না। প্রতি তিন মাস পরপর ড্রর ফল দেখা ও মেলানো কঠিন। এতে অনেকেই পুরস্কার জিতেছেন কি না, তা জানতে পারেন না। অনলাইনে মেলানোর জন্য এই (nationalsavings.gov.bd) ওয়েবসাইটে যেতে হবে আর অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে। স্মার্ট সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে প্রাইজবন্ড ঝুঁকিমুক্ত এবং লাভজনক হতে পারে। বিনিয়োগ পরিকল্পনায় এটি মধ্যবিত্তের জন্য একটি উপযুক্ত পছন্দ।