মা খেয়াল করলেন, তার এক বছর বয়সী সন্তান এখনো ‘টাটা’ দেয় না। অন্য বাচ্চারা খেলায় মেতে ওঠে, কিন্তু তার বাচ্চা যেন নিজের জগতে বন্দি। ডাকলে তাকায় না, আনন্দে লাফায় না। এমনকি খেলনার প্রতিও আগ্রহ নেই তেমন। ভয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি ছুটলেন চিকিৎসকের কাছে। সেখানে মিললো ‘অটিজম’ শব্দটির দেখা।
এই একটি শব্দ এখন যেন পৃথিবীর অসংখ্য মা-বাবার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কিন্তু কেন এই অটিজমের সংখ্যা হঠাৎ করে এত বেড়ে যাচ্ছে? শুধুই কি রোগ, নাকি এর পেছনে আছে আরও জটিল ব্যাখ্যা?
অটিজমের বর্তমান চিত্র, পরিবারের ভূমিকা, সচেতনতার ঘাটতি ও বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট এর নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাওলী সরকার।
বিশ্বে অটিজম বাড়ছে, বাংলাদেশেও তার প্রভাব
নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার হিসেবে অটিজম কোনো রোগ নয়। বরং এটি বিশেষ মস্তিষ্কজনিত বিকাশগত অবস্থান। শিশুদের মধ্যে সামাজিক মেলামেশা, ভাষা ও আচরণের ক্ষেত্রে ঘাটতিই অটিজমের বৈশিষ্ট্য। ডা. শাওলী সরকার জানালেন, গত দশ বছরে অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতি ৩৬ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজম আক্রান্ত। এমন যদি চলতে থাকে, গবেষণা বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৫০ জন নিউরোটিপিকাল (স্বাভাবিক) শিশুর সঙ্গে থাকবে ৫০ জন অটিজম আক্রান্ত শিশু!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিজমে আক্রান্ত। আর ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতি ১০০০ জনে ৩০ জন শিশু এই অবস্থায় ভুগছে। যেখানে গ্রামের হার ছিল মাত্র ০.৬%। ২০১৮ সালে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ০.৭৫%-এ।
শহরে কেন বেশি, গ্রামে কম?
শহরে পরিবেশ দূষণ, বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়া, মায়ের গর্ভাবস্থার বিষন্নতা এই সব মিলেই যেন অটিজম বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করছে।
অন্যদিকে, গ্রামের চিত্র ভিন্ন। সেখানে সেরিব্রাল পালসি ও এপিলেপসি আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি। কারণ গ্রামে এখনো বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতা শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা তৈরি করে। যার ফলস্বরূপ শিশুর হাত-পা বাঁকা হয়ে যেতে পারে, হাঁটতে পারে না, এটাই সেরিব্রাল পালসি।
আগে ছিল, শুধু বুঝত না কেউ
“অটিজম আগেও ছিল, এখন শুধু আমরা বুঝতে শিখেছি।”— বলেন ডা. শাওলী সরকার। আগে একটি শিশু যদি দেরিতে কথা বলত, বাবা-মা কিংবা চিকিৎসকেরা বলতেন, সময় হলে কথা বলবে। অথচ সেসব শিশুর অনেকেই পরে গিয়ে অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচিত হতো। অটিজম হিসেবে চিহ্নিত হতো না।
সচেতনতা এখন রোগ নির্ণয় বাড়িয়েছে। ফলে সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, যেসব শিশুকে আগে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলা হতো, এখন তাদের অনেকেই অটিজম স্পেকট্রামে পড়ে।
কখন সাবধান হবে?
ডা. শাওলী সরকার অটিজম শনাক্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংকেতের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। যেগুলো শিশুর প্রথম ছয় মাস থেকেই বোঝা সম্ভব।
৬ মাসে মুখ দেখে হাসে না, চোখে চোখে তাকায় না। ৯ মাসে নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। ১২ মাসে টাটা, তাই-তাই জাতীয় খেলা রপ্ত করতে না পারা। ১৫ মাসে খেলনা দেখিয়ে শেয়ার করার আগ্রহ নেই। ১৮ মাসে পয়েন্টিং করে না। ২৪ মাসে অন্যের মনোভাব বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
এই লক্ষণগুলো দেখা গেলে অপেক্ষা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রথম ১০০০ দিন মস্তিষ্ক গঠনের ভিত্তি
গর্ভাবস্থার ২৮০ দিন এবং শিশুর পরবর্তী দুই বছর এই সময়টিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘গোল্ডেন ১০০০ ডেইস’। এই সময়টাই শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব মায়ের বিষন্নতা, দূষণের প্রভাব এসব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে মায়ের ও বাবার বয়স যেন ৩৫ পেরোনোর আগেই সন্তান নেওয়া হয়, এটাও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
থেরাপি-ই ভরসা
অটিজমের কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। চিকিৎসার মূল কৌশলই হলো আর্লি ইন্টারভেনশন। প্রথম থেকেই থেরাপির মাধ্যমে শিশুকে উন্নতির পথে আনা। স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, বিহেভিয়ার ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে শিশুকে ধাপে ধাপে উন্নয়নের পথে নেওয়া হয়। শিশুর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা নির্ভর করে তার ভাষাগত দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য মানসিক অবস্থার ওপর।
একটি বার্তা অভিভাবকদের জন্য
আপনার শিশু দেরিতে কথা বলছে, এটুকু দিয়ে বিচার করবেন না। অটিজম মানেই শেষ নয়, বরং শুরু। দ্রুত শনাক্ত করুন, দ্রুত থেরাপি শুরু করুন। ভুল করেও ভাববেন না, সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
একটি শিশুর জীবন, তার ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার হাতেই। আর মনে রাখবেন প্রতিটি শিশু আলাদা, প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময়।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে ২ বছর বয়সের আগে মোবাইল বা টেলিভিশন দেখানো উচিত নয়। এটি শিশুর ভাষাগত ও সামাজিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।