Home সর্বশেষ যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সুরক্ষার সীমানা

যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সুরক্ষার সীমানা

সুপ্রভা জুঁই 
২৫৩ views
সতী কি অসতী এসব দিয়ে নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির যোগ্যতা ও অযোগ্যতা যাচাই করা যাবে না - ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ছবি: এম্বাসেডর অফ জি-১৭ ইউএসি বাংলাদেশ

জি-১৭ ইউনিভার্সিটি অ্যাম্বাসেডরস কনসোর্টিয়াম— একটি মর্যাদাপূর্ণ বৈশ্বিক ফেলোশিপ প্রোগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করে। এই প্রোগ্রামটি তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ করে যেন তারা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (SDGs) অর্জনে অবদান রাখতে পারে।

এ বছর অক্টোবর মাসের জন্য জি-১৭, SDG-5 লিঙ্গ সমতা ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি সেমিনার আয়োজন করে। গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তা হিসেবে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা। দীর্ঘ ২৪ বছরের গবেষণা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তার। ‘সুরক্ষিত সীমানা: নিপীড়নের বিরুদ্ধে সীমানা ও সুরক্ষা বজায় রাখা সম্পর্কিত সেমিনার’ শীর্ষক এই আয়োজনে দুই পর্বে বক্তব্য রাখেন তিনি।

অধ্যাপক ফাতেমা গবেষণার আলোকে দুটি প্রধান বিষয়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। প্রথমত, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবাক হওয়া। দ্বিতীয়ত, নিপীড়নের বিচার পাওয়ার উপযুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। এর জন্য সামাজিক ও আইনগতভাবে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামীতে কি করণীয় তারই আভাস দেন তিনি।

নিপীড়নের ক্ষেত্রে সামাজিক ও আইনগত সমস্যা

সরকারি হেফাজতে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয় ‘ভিক্টিম’কে (যিনি নিপীড়নের শিকার), নিপীড়ককে নয় কেন— তরুণদের এমন এক প্রশ্নের সম্মুখীন করান অধ্যাপক ফাতেমা। কারণ যৌক্তিকভাবে যে অপরাধী তাদেরকে আটক করে পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। অথচ আমাদের সামাজিক বাস্তবতাটা এমন যে, যিনি নিপীড়নের শিকার অর্থাৎ ভিক্টিমকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আলাদা করে রাখতে হয়। ভিক্টোরিয়ান যুগে অর্থাৎ ১৮২০ থেকে ১৯১৪ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণা ছিল— ‘উন্মাদ’ ও ‘বেশ্যা’ ছাড়া কারও সাথে যৌন হয়রানি ঘটে না। অর্থাৎ, পাগল বা বেশ্যাদের জাতই নেই, তাই জাত চলে যাওয়ার ভয় নেই বলে তারা নিপীড়নযোগ্য। অপরদিকে সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণির নারীদের দৈহিক শুচিতার গুরুত্ব এতটাই যে সেখানে ঘটা কোনো নিপীড়নের গল্প লোকসমাজে বের হয় না।

অধ্যাপক ফাতেমার গবেষণায় উঠে এসেছে, যৌন নিপীড়নকারীদের ৪৭ শতাংশই পরিবারের সদস্য বা ভিক্টিমের পরিচিত কেউ। এমন মর্মান্তিক একটি তথ্য জেনে সেমিনার কক্ষে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ দেখা যায়। ফাতেমা বলেন, ধর্ষক মানেই তারা পুরুষ এবং ধর্ষণের শিকার মাত্রই একজন নারী— এমন একটা বাইনরি চিন্তার জগতে থাকি। অথচ ধর্ষকের সাথে লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় যুক্ত নয়। নারীদেহের শুচিতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই বিভেদটা বোঝা একটা প্রাথমিক বিষয়।

গবেষক ফাতেমার নেওয়া ৯ জন ভিক্টিম নারীর সাথে নিবিড় সাক্ষাৎকার থেকে উঠে এসেছে লোমহর্ষক কিছু তথ্য। তাদের প্রত্যেকের আঙ্গুলে ক্ষত, মুচড়ে গিয়েছে কিংবা কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া শারীরিকভাবে তারা ভালো জখমের শিকার। কিন্তু কবে কিভাবে এই আঘাত হয়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে কেউই সঠিক মনে করতে পারেন না! কারণ নিপীড়িত নারীর সাথে একবার নয়, বারংবার হয়রানির ঘটনা ঘটতে থাকে। ধর্ষণের শিকার নারীর ইজ্জত নেই বলে তাকে আবারও সহজলভ্য হিসেবে ধর্ষণের জন্য টার্গেট করা হয়। পাশাপাশি সামাজিকভাবে এবং আইনগত প্রক্রিয়ার অমানবিক অভিজ্ঞতা তাদের মনোবল এমনভাবে ধূলিসাৎ করে দেয় যে তাতে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়।

এই যে বারবার হয়রানির শিকার হতে হয়, এটার একটা মূল কারণ হিসেবে ফাতেমা ঘটনাটিকে বিচারালয়ে উকিলের উপস্থাপনের পদ্ধতিকে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে সাক্ষীর বয়ানের সাথে অনেক সময় উকিলের বর্ণনা মেলে না। এতে বিচার পাওয়া কঠিন হয়। বাস্তবে যা ঘটেছে তা মামলায় জেতার জন্য ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ফাতেমা একটা কেস স্টোরি বলেন। ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ করা হলেও উকিলের বয়ানে বলা হচ্ছে দরজা ভেঙে ধর্ষণ করা হয়েছে। ফলে এজহার ও সাক্ষ্য মেলে না। কিন্তু এমনটা উকিলদের করতে হয় কেন? কারণ ওষুধ খাওয়ানো গিয়েছে যেহেতু, তাহলে মেয়েটি ছেলের পরিচিত এবং সেই কারণে এই মামলার আরও অনেকগুলো অ্যাঙ্গেল তৈরি হতে পারে, যেখানে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব।

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ টু ফিংগার টেস্ট প্রচলিত ছিল। যোনিদেশের শিথিলতা বোঝার জন্য এই পরীক্ষা করা হতো। প্রশ্ন হলো, সব ডাক্তারের দুই আঙ্গুল সমান হয় কিনা এবং এটা কিভাবে মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারিত হলো? দশ বছর আগের মামলার বাদীকেও এই টেস্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাক্ষ্য নেওয়ার সময় নারীর স্তনের আকার নিয়েও একটি ক্যাটাগরি থাকে যেখানে স্তন আকারে ছোট, বড় নাকি ঝুলে পড়া— এই বিভাগগুলো লেখা থাকে। ঝুলে পড়ার তালিকাভুক্ত নারীদেরকে ওকালতি ভাষায় বোঝা হয় তারা নিয়মিত যৌন সঙ্গম করেন। ফলে নারী যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত হলে তাকে সতী নারী হিসেবে দেখার জায়গাটি ক্ষীণ হয়ে আসে। এইসব অকাজের যুক্তি দিয়ে নারীর চারিত্রিক খুঁত বের করে তার বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাকে জটিল করে করে আমাদের আইনি প্রক্রিয়া। ফামেতা বলেন, সতী কি অসতী— এসব দিয়ে নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির যোগ্যতা ও অযোগ্যতা যাচাই করা যাবে না।

সুরক্ষা হিসেবে আমাদের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হলো ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ানো - ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ছবি: এম্বাসেডর অফ জি-১৭ ইউএসি বাংলাদেশ

সুরক্ষা হিসেবে আমাদের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হলো ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ানো — ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা। ছবি: অ্যাম্বাসেডর অফ জি-১৭ ইউএসি বাংলাদেশ

নিপীড়ন থেকে নিজেদের সুরক্ষা করার উপায়

আমাদের সমাজে একজন মেয়েকে শাস্তি দিতে হলে ওড়না ধরে টান দেওয়া হয় আর, ছেলেকে প্রহার করা হয়। অর্থাৎ নিপীড়নের মাঝে জেন্ডারের প্রভাব স্পষ্ট। তাহলে এমন অবস্থায় সুরক্ষা ও বিচার নিশ্চিত করতে হতে হলে কি করণীয়? আমরা জানি যে নীতিগত পরিবর্তন আনা সহজ কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তবে অসম্ভব নয়। ফাতেমা বলেন, অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে যেমন জোরালো গলায় আমরা প্রতিবাদ করি এবং বিচারের দাবি করি, ঠিক একইভাবে যৌন সহিংসতার জন্য সোচ্চার হতে হবে। ফলে নিজের গল্পটা আমাদের নিজেদেরকে বলতে পারতে হবে। এবং এটা মেনেই নিতে হবে যে এ নিয়ে সোচ্চার হলে আমাদের সামাজিক কিছু ক্ষতি হবে, লোকে নানা কথা বলবে। কিন্তু স্বনামে নিজের গল্পটা বলতে হবে এবং অন্যরাও যেন বলতে পারে, সে রকম একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে তখন প্রথমে যা করতে দেখা যায় তা হলো ভিসি অফিস ঘেরাও করা। অথচ আইনত ভিসি কাউকে গ্রেফতার করার বা বিচার করার ক্ষমতা রাখেন না। এই ঘেরাও ঘটনাগুলো বিচার না পাওয়ার একটা ফাঁক বলে মনে করেন ফাতেমা। ফৌজদারি কোনো ঘটনার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন রাখে না— এটাই আমাদের সবার আগে জানার কথা ছিল। কারণ যেভাবে আমরা বিচার দাবি করছি, সেটা মোটেও কার্যকর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন নীতিমালা ও কমিটি সচল থাকতে হবে। তারা আইনি ব্যবস্থায় যেতে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করবেন। তাছাড়া এই ঘেরাও কর্মসূচি অনেকখানি রাজনৈতিক। পুঁজিবাদে নারীদেহ হলো ক্ষমতার ক্ষেত্র। তাই এই ঘটনার সময় দুটি পক্ষ রচনা করে সরকারকে সমালোচনা ও সমর্থন করার কিছু রসদ হয়। তাই আবারও বিচার পাওয়া থেকে আমরা দূরে চলে যাই।

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মাঝে মাত্র ৮টি জেলাতে ওসিসি বা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল আছে। সেই ৮ জেলা সদর হাসপাতালে ভিক্টিমের জন্য আলাদা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা আছে। কিন্তু সেগুলো কতটা সচল কিংবা সেগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা অবগত? তাছাড়া এই ওসিসিগুলো যেখানে অবস্থিত সেখান থেকে ভিক্টিম অনেক দূরে থাকতে পারেন। তখন তার জন্য সেখান আসার মানসিক ও আর্থিক অবস্থা আছে কি না বা এই সময়ের মাঝে প্রমাণ থাকবে কি না— এগুলো ভেবে দেখা খুব দরকার। তাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে শারীরিক শুচিতার জায়গাটি আমাদের একদম উপড়ে ফেলে দিতে হবে। কেবল তখনই আমরা প্রমাণগুলো ধরে রাখার জন্য যে যে কৌশল অবলম্বন করা দরকার তা করতে পারব। পাশাপাশি নিজের অভিজ্ঞতা বিচারালয়ে তুলে ধরার সামর্থ্য অর্জন করব। সন্দেহ নেই এমন একটি জঘন্য ঘটনা নিজের সাথে ঘটলে কি করব তা নিয়ে আগ বাড়িয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু মনের মাঝে যে শুচিতা ও ইজ্জত হারানোর ভীতি আছে, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলেই এমন গা ঘিনঘিনে ভাব তৈরি হয় কেননা অন্যান্য অপরাধের প্রমাণ রাখার ক্ষেত্রে আমাদের লজ্জাবোধ হয় না।

আইন ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারণ হলো আমাদের শিক্ষক, উকিল ও বিচারকদের প্রশিক্ষণের অভাব। এই কারণে সুরক্ষা হিসেবে আমাদের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হলো ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ানো। এবং এই পরিবেশ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সকল নারীর জন্যই একটি উন্মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে যৌন হয়রানির জন্য আমাদের নীতিমালা আছে, কিন্তু আইন নেই। ফলে একেক  বিশ্ববিদ্যালয় একেকরকমভাবে এই ঘটনাগুলোকে দেখে থাকে। এ জন্য বিচার পেতে জটিলতা হয়। তাই আমাদের গবেষণার প্রয়োজন আছে। নানা ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় জানার প্রয়োজন আছে। নারী-পুরুষ সকলের সাথেই কথা বলতে হবে। আইনত প্রমাণগুলো কি কি এবং কিভাবে এই প্রমাণ সংরক্ষণ করা যেতে পারে, সেখানে আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি নীতিমালা ও আইন সংস্কার এবং সংযোজনের ধারাটি অভিজ্ঞ কমিটি দ্বারা অব্যাহত রাখতে হবে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ