Home সাহিত্য আমার বাবাটা না একটা গাছ হয়ে গিয়েছে

আমার বাবাটা না একটা গাছ হয়ে গিয়েছে

পরাবাস্তব গল্প

সুপ্রভা জুঁই 
১৫৬ views
আমার বাবাটা না একটা গাছ হয়ে গিয়েছে

ছোটবেলা থেকে বাবা আমাকে নিজ হাতে মানুষ করেছে। আমি মা মরা মেয়ে বলে আদর পেয়েছি খুব। আমার কোনো চাহিদায় অপূর্ণ থাকেনি। চাহিদাগুলো যে খুব বড় ছিল তাও নয়। আমি কমলা খেতে খুব ভালোবাসতাম, আজও বাসি। ভাত না খেলেও চলবে কিন্তু কমলা আমার চাই-ই চাই। বাবাও রোজ কিভাবে যেন কমলা জোগাড় করে আনতো। যে সময় কমলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না সে সময়ও বাবা কমলা নিয়ে আসতো বাসায়! আমি হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও বাবা কিছুতেই বলতো না যে সে কিভাবে কমলা জোগাড় করেছে। তাও আমি জানার জন্য জোর করতাম। বাবা তখন বলতো, এটা নাকি ম্যাজিক! আর এই ম্যাজিক যেদিন আমি জেনে যাবো সেদিন নাকি বাবা আর বাবা থাকবে না!

আমার প্রতিবেশী গগণ আমার সাথে কমলা খেতো। কিন্তু বাবার কাছে কমলার সিক্রেট জানতে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। ব্যাপারটা নিয়ে যে গগণের বিন্দুমাত্র কৌতুহল ছিল না তাতে আমি বেশ বিরক্ত হতাম। বাবার কাছে কমলা আনার পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা সিক্রেট। আমি অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও এই সিক্রেটের কোনো সুরাহা করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। এমন একটা ভাব করে চলতাম যেন রোজ বাসায় কমলা আসাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক কমলা খাওয়ালেও বাবার সবসময় কড়া একটা নির্দেশ ছিল, কমলার ভিতরে থাকা বীজ যেন না খাই। কারণ সেই বীজ খেলে তা থেকে মাথা দিয়ে গাছ গজিয়ে যাবে! বাবার এই অদ্ভুত কথাটি আমি আর গগণ কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিতাম। কমলার বীজগুলো রাখার জন্য বাবা আলাদা করে একটা ছোট বাটিও দিত আমাদের। 

বাবার বদলি হলো। আমরা আজিমপুর ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি। গগণকে ছেড়ে আসতে আমার একদম ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আমি কোনো কান্নাকাটি বা জোরাজুরি করিনি। কারণ আমার বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি। সেদিন বাবা আমাকে আর গগণকে একসাথে বসিয়ে একটা কমলা খাইয়েছিল। যদিও তা দেখতে অবিকল আপেলের মতো। বাবা বলেছিল, এর নাম ‘আপলা’, মানে আপেল+কমলা। বাইরেটা দেখতে আপেলের মতো হলেও ভিতরে ছিল কমলার কোয়া। সেদিন আজিমপুরের সরু গলি ধরে যখন আমাদের গাড়িটা ছেড়ে যাচ্ছিল, আমি দেখছিলাম গগণ কেমন হুহু করা মন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। এর আগে কখনো এমন হয়নি। আমি দেখলাম গগণের হাতের মুঠির মাঝে কমলার কিছু বীজ আলতো করে ধরে রাখা কিন্তু তার সাথে কিছু মাটিও মেশানো আছে। গগণ এক এক করে সবগুলো বীজ খেয়ে নিলো। তা দেখে আমি প্রবল আতংকে দু’চোখ চেপে ধরলাম। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকি আমি। আমি কাঁদলেই বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে কান্নার বেগ বাড়তে থাকায় বাবা আমাকে তার কোলের মাঝে নিয়ে নেয়। আমাকে অনেক চুমু দিয়ে আদর করে কমলা সাধে, কিন্তু সেই থেকে বেশ কিছুদিন আমি আর কমলা খেতে পারিনি। 

456

এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গিয়েছে। বাবা রোজ সকালে একটা কমলা এনে দেয়, সেটা খেয়ে হাসতে খেলতে আমার দিন শুরু হয়। আর এমন করে আমি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করি। বাবার এই কমলা জোগাড়ের ম্যাজিক নিয়ে এরপরেও কিন্তু আমি কোনো প্রশ্ন তুলিনি। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। মাঝে মাঝে বাসায় বেড়াতে আসা বান্ধবীরা খুব অবাক হতো।

তারাও একটা করে সুস্বাদু কমলা পেতো, তাই তেমন প্রশ্ন কারো মনেই দানা বাঁধতে পারেনি। তাছাড়া রহস্যের উদ্ঘাটন মানুষ আসলে চায় না। দিন কাটছে, তালে তালে বাবারও বয়েস হচ্ছে। ইদানিং তার আনা কমলাগুলোও মলিন দেখায়। একদিন একটা কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পেলাম। বাবা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল। এক মাসের চাকরি শেষে বেতন উঠিয়ে যখন বাবার হাতে দিলাম সেদিন বাবা আমাকে আর কমলা দিল না। তার চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। সকাল সকাল সেদিন ঘুমিয়েও গেলো বাবা। তাই আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। পরদিন দেখলাম বাবার বিছানায় আর বাবা নেই। তার বদলে কিছু কমলার বীজ আর একটা কমলার বনসাই গাছ রয়েছে। গাছটা বাবার গত রাতের গায়ে থাকা পাঞ্জাবিতে ঘেরা। আমার বুঝতে এক মুহূর্ত বাকি থাকলো না যে এটাই আমার বাবা। আমি একটুও অবাক হলাম না। ঘরের পর্দাটা টেনে দিলাম জলদি করে যেন কেউ না দেখে।

আজব ব্যাপার হলো, কেউ বিশেষ প্রশ্ন করেনি আমাকে। সবাই এই কমলা বনসাই বাবা-গাছটাকে মেনেই নিয়েছিল। সবাই বুঝত যে এই গাছটা আমার বাবা। বাবা-গাছটাকে সাইকেলের সামনের ঝাঁপিতে বসিয়ে সাথে নিয়ে আমি রোজ কলেজে পড়াতে যাই। স্টুডেন্টদের বেঞ্চেরই এক প্রান্তে তাকে রাখি আমি। বিকেলে ফুচকা খেতে বের হই। বেশ সেজেগুজে ঈদ করি আমি আর বাবা। আমি সাজলে বাবার ডালপালাগুলোতে কেমন যেন আলাদা একটা চমক আসে!  কিছুদিন আগে বান্ধবীর বিয়েতেও আমরা একসাথে দাওয়াত খেয়ে এলাম। লোকজন যে গাছটার সাথে কথা বলে এমন নয়, কিন্তু তারা আমাকে এই গাছটার সাথে দেখবে এটা মেনে নিয়েছে। মাঝে মাঝে আমি আর বাবা-গাছ সাইকেলে করে ঘুরতে বের হই। নদীর ধারে দুজনে নিশ্চুপ বসে থাকি। বাতাসের সরসর শব্দ শুনি আর নদীর ঢেউ গুনি। একদিন মনে হলো, বাবার হয়তো নৌকায় ঘুরতে ইচ্ছে করছে বা নাগোরদোলায় চড়তে ইচ্ছে করছে যেমনটা আমরা ছোট থাকতে ঘুরতাম। তখন বাবা-গাছকে সাথে নিয়ে আমি সেই শখগুলো পূরণ করে আসি। আমার বাবা-গাছটা সেসময়গুলোতে আনন্দে দুলতো। এসব কিছুর মাঝে শূণ্যতার কোনো জায়গা ছিল না, থাকার কথা না। কিন্তু আমি রোজ বাবার দেওয়া একটা করে কমলা খুব মিস করতাম।

একদিন বাবা-গাছটা থেকে প্রচুর পাতা ঝরতে শুরু করলো। গাছটা প্রায় মরতে বসেছে ভেবে আমি খুব অস্থির হয়ে পড়ি। দ্রুত সাইকেলে চেপে হাসপাতালে যাই কিন্তু ওরা বনসাই কমলা গাছের অন্তিম মুহূর্তে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। একটা অসুস্থ গাছকে নিয়ে মানুষের হাসপাতালে যাওয়ার মত মূর্খামির জন্য আমার সাথে ওরা কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। ইনফ্যাক্ট, আমার সাথে সেই শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত কেউই খারাপ আচরণ করেনি। আমার সামনেও আমি কাউকে খারাপ আচরণ কোনোদিন দেখিনি। বাবা তাই আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন আমি নাকি দেবশিশু! আমার অসহায়ত্ব হাসপাতালের সকলের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। ওরা আমাকে স্থির হতে সময় দিয়েছিল, কাঁধে হাত রেখেছিল। সম্বিত ফিরে পেতেই সাইকেলে চেপে দ্রুত বনবিভাগে নিয়ে আসি বাবা-গাছটাকে। এই পুরো যাওয়া-আসার সময়টায় গাছ থেকে প্রায় সব পাতাই পড়ে যেতে থাকে। বনবিভাগে ঢুকে সাইকেল ফেলে গাছটাকে কোলে নিয়ে মাটিতে বসে আমি অঝোরে কাঁদতে থাকি। আমি কাঁদলেই কেন যেন বৃষ্টি পড়ে। সেদিনও বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। বনবিভাগের কর্মীও গাছটা দেখে কিছু বলতে পারলো না। আমি সেখান থেকে ফিরে আসার জন্য বের হই। প্রবল কান্নায় বৃষ্টির মাঝে চোখে কিছু না দেখতে পেয়ে সাইকেল থেকে পড়ে যাই। গাছটাও মাটিতে পড়ে যায়। গাছটা ততক্ষণে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। আমার শরীরে একদম বল নেই যে আমি নিজেকে তুলবো। জ্ঞান হারানোর একদম দোরগোড়ায় ছিলাম। কাদামাটিতে শুয়ে শুয়ে আমি দেখতে পাই, একটা ছেলে এসে গাছটা তুলে নিয়েছে। তার মাথায় বিশাল পাগড়ি। সাধুবাবার মতো দেখতে এই ছেলেটা খুব চেনা চেনা।

789

সে আমাকেও শক্ত করে ধরে তুলে দাঁড় করালো। গাছটাকে আমার সাইকেলের সামনে ক্যারিয়ারে রেখে সে চালকের আসনে বসে। আমাকে পিছনে বসতে ইঙ্গিত করে। আমিও বসি, আমার একটা আশ্রয় খুব দরকার এখন। বাবাকে হারিয়ে আমি সেই জায়গাটা যেন হারিয়েছি। তাই সেই পাগড়ি পরা ছেলেটা আমাকে যা যা বলছিলো আমিও ঠিক তাই করছিলাম। আমি তার কাছে শিশু হতে চেয়েছিলাম।

ছেলেটা আমার হাত টেনে নিয়ে তার কোমরে পেঁচিয়ে নেয়, যেন সাইকেল চলতে শুরু করলে আমি না পড়ি। বৃষ্টির মাঝে সারা রাস্তা আমি ছেলেটাকে জাপ্টে ধরে থাকি। আমার সমস্ত ভারটাই ওর ওপরে দিয়েছিলাম সেদিন। তার শরীররময় আমার বাবার মতোই গাছের ঘ্রাণ। আচ্ছা, ছেলেটা আমার বাসা চিনলো কি করে! এই প্রশ্ন আমার সেদিন মাথায় যে কেন আসেনি! বাসায় এসে গাছটাকে সে বাবার ঘরের বিছানায় রাখে। আমাকে একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে বসার ঘরে নিয়ে আসে। আমি তাকে দেখতে থাকি। চেনা চেনা লাগছে কেমন। সে পাগড়িটা পাকিয়ে পাকিয়ে খুলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সেখানে একটা কমলার গাছ গজিয়েছে। এসবকিছু দেখে আমার মুখ থেকে কেমন অবলীলায় গগণ নামটা বেরিয়ে আসে। গগণ সেই ছোটবেলায় কমলার বীজ খেয়েছিল বলে আসলেই ওর মাথায় গাছ গজিয়েছে। আমি গগণের মাথার ওপরে থাকা কমলা গাছটার ডালপালদের আদর করি। গাছটায় চড়ুই এসে বসছিল, কয়েকটা প্রজাপতিও এলো। আমার এত আনন্দ হচ্ছিল! খেয়াল করিনি কিন্তু ততক্ষণে বাবা-গাছটায় ছোট ছোট নতুন কচি সবুজ পাতার আগমন ঘটেছে। আমার খুশিতেই যে বাবার খুশি! আমি বাবা-গাছটার দিকে আনন্দে মুখ ফিরিয়ে দেখি, আমার বাবাটা একটা চমৎকার সতেজ পাতায় স্নিগ্ধ বনসাই কমলা গাছে আবার রূপ নিচ্ছে ঠিক ফিনিক্স পাখির মতন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির আনন্দে মুখরিত চারপাশ।

আমার ছোটবেলার বন্ধুটার মাথায় একটা ফুটফুটে কমলা গাছ আছে। আমার বাবা একটা বনসাই কমলা গাছ। চায়ের কাপ সাথে করে সকালের উষ্ণ রোদে আমি ওদের ঝলমল করতে দেখি। আমার নিরাকার-সাকার চেহারাদ্বয় এক হয়ে ওঠে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ