Home লাইফস্টাইল দেশে দেশে ঈদের রঙ

দেশে দেশে ঈদের রঙ

ফাহমিদা শিকদার
৩১ views

ঈদুল ফিতর বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি। রমজানে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। যদিও ঈদুল ফিতর মুসলিম বিশ্বে একটি সাধারণ ধর্মীয় উৎসব, তবে বিভিন্ন দেশে একে উদযাপনের রীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, আনন্দ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেরও প্রতিফলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপনের ধরন ভিন্ন হলেও সার্বিকভাবে ঈদের মূল চেতনা—সংহতি, ত্যাগ, ও পারস্পরিক ভালোবাসা—অপরিবর্তিত রয়েছে।

সৌদি আরব
সৌদি আরব, যেখানে ইসলামের দুই পবিত্রতম স্থান মক্কা ও মদিনা অবস্থিত, সেখানে ঈদের উদযাপন অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতায় অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের দিন সকালে পবিত্র কাবা শরিফে লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটে। নামাজের পর সৌদির বাসিন্দারা পারিবারিকভাবে বিশেষ খাবার—কাবসা (মাংস ও সুগন্ধি চালের তৈরি খাবার), সাম্বুসা ও খেজুর খেয়ে ঈদ উদযাপন করেন। ঈদের সময় আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, দান-খয়রাত করা ও শিশুদের ‘ঈদিয়া’ (ঈদ উপহার) দেওয়া সৌদি সংস্কৃতির অংশ।

তুরস্ক
তুরস্কে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় “রমজান বাইরামি” । এখানে ঈদে ছোটরা বড়দের হাতে চুমু দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়, যা সম্মানের প্রতীক। ঈদের সময় বাড়িঘর পরিষ্কার করা, নতুন পোশাক পরা ও বিশেষ মিষ্টান্ন ‘বাকলাভা’ তৈরি করা তুর্কি সংস্কৃতির অংশ। তাছাড়া, স্থানীয় সরকার গরিব ও অভাবীদের জন্য বিশেষ খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করে।

Bogazdacumhuriyet2007

তুরস্কের কোথাও কোথাও ঈদের সময় আতশবাজি ফাটানো হয়, ছবি: উইকিপিডিয়া

মিশর
মিশরে ঈদ উদযাপন এক প্রাণবন্ত উৎসব। ঈদের নামাজ শেষে নদীর ধারে বা পার্কে পরিবার ও বন্ধুরা একত্রিত হয়ে দিন কাটায়। জনপ্রিয় ঈদ খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘ফাতা’ (গরুর মাংস, ভাত ও রুটি দিয়ে তৈরি খাবার) এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। এছাড়া, মিশরে ঈদের সময় নাটক, সংগীত ও সিনেমা মুক্তির প্রচলন রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের বিনোদনের বড় অংশ।

ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ঈদকে বলা হয় “হারি রায়া ইদুল ফিতরি”। এখানকার বড় ঐতিহ্য হলো ‘মুদিক’, যার মাধ্যমে ঈদের সময় লাখো মানুষ গ্রামে ফিরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটায়। ঈদের আগের রাতকে “তাকবিরান” বলা হয়, যেখানে মানুষ মসজিদে গিয়ে তাকবির পড়ে এবং আতশবাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বিশেষ খাবারের মধ্যে আছে ‘কেতুপাত’ (নারকেলের দুধে রান্না করা চালের কেক)।

Eid ul Fitr

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উপলক্ষে পরিবারের কাছে ফেরাকে ‘মুদিক’ বলে, ছবি: ইউনিভার্সিটি রিডিং ওয়েবব্লগ

পাকিস্তান
পাকিস্তানে ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়। ওদের ঈদ উদযাপনের সঙ্গে আমাদের উদযাপনে পার্থক্য খুব কম। ঈদের আগের রাতকে ‘চাঁদ রাত’ বলা হয়, যেখানে মেয়েরা মেহেদি পরিধান করে ও বাজারগুলোতে কেনাকাটার ভিড় জমে। ঈদের দিনে সকালে সেমাই ও ‘শির খুরমা’ (দুধ, খেজুর, বাদাম ও সেমাই দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন) পরিবেশন করা হয়। এছাড়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়।

মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ায় ঈদকে বলা হয় ‘হারি রায়া আদিলফিতরি’। এখানে ঈদের অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘ওপেন হাউস’, যেখানে প্রতিবেশী ও বন্ধুরা একে অপরের বাড়িতে গিয়ে খাবার খায় এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘রেনডাং’ (গরুর মাংস ও নারকেল দুধের মশলাদার তরকারি) এবং ‘লেমাং’ (বাঁশের মধ্যে রান্না করা চাল)।

আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো “জশনে ঈদ”, যেখানে বিশেষ খেলা ‘বুজকাশি’ (ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা) আয়োজন করা হয়। বাড়ির বড়রা ছোটদের ‘ঈদি’ দেন এবং বিশেষ খাবার ‘শির খুরমা’ পরিবেশন করা হয়।

image

আফ্রিকায় অনেকে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ঈদের জামাতে অংশ নেয়, ছবি: ওকে আফ্রিকা

নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়ায় ঈদ একটি বিশাল সামাজিক অনুষ্ঠান। ঈদের নামাজের পর বর্ণাঢ্য প্যারেড, ঘোড়সওয়ারী শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে ‘জোলফ রাইস’, ভাত, মাংস ও মশলা দিয়ে তৈরি একটি সুস্বাদু পদ, অন্যতম জনপ্রিয়।

মরক্কো
মরক্কোতে ঈদের সময় বিশেষ ধরনের পোশাক ‘জাবাদোর’ ও ‘গ্যান্ডুরা’ পরার চল রয়েছে। ঈদের দিনে বিশেষ খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় ‘মেঘরেবি ট্যাজিন’, যা মাংস ও মশলার একটি সুগন্ধি পদ।

thenationalnewsdotcom

অনেক আরব দেশে ঈদের দিন এভাবেই ‘দস্তরখানা’ বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করার রীতি রয়েছে, ছবি: উইগো ট্রাভেল ব্লগ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপনের ধরন আলাদা হলেও ঈদের মূল উদ্দেশ্য— আনন্দ ভাগাভাগি করা, দরিদ্রদের সাহায্য করা ও পারস্পরিক সংহতি বজায় রাখা—সব জায়গাতেই অভিন্ন। এভাবেই ঈদ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম সংস্কৃতিকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতরের উদযাপনের রীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও উৎসবের মূল উদ্দেশ্য একই—পরিবার-পরিজনদের সাথে সময় কাটানো, আনন্দ ভাগাভাগি করা এবং দান-সদকা করা। এই উৎসব যেমন আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, তেমনি এটি সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ