ইসলাম ধর্মালম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নাম শবে বরাত। হিজরি বর্ষের শাবান মাসের ১৪ তারিখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সৌভাগ্যের রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ ধর্মপ্রাণদের জন্য কৃপার দরজা খুলে দেন। তাই এই রাতটি পবিত্র শবে বরাত হিসাবে পালিত হয়। ‘শবে বরাত’ শব্দ-যুগল ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি। আরবি শব্দ ‘বারাআত’র অর্থও মুক্তি। তাই শবে বরাত অর্থ হবে মুক্তির রাত।
হাদিস শরিফে রাতটিকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে– এটি এমন একটি রাত, যে রাতে বান্দাকে তার প্রতিপালক গোনাহ থেকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমা করে দেন। এখান থেকেই ফার্সিতে এটিকে ‘শবে বরাত’ আখ্যা দেওয়া হয়। মানে মুক্তির রাত। আরবি ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ আমাদের এ অঞ্চলে শবে বরাত নামে পরিচিত।
হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। সেই রাতে তিনি মুশরিক এবং অন্য ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে বাজজার: ৮০, মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৬৬৪৬)
কুরআনুল কারিমের ভাষায় একে বলা হয়েছে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রাত, আর হাদিস শরিফে এটি ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলে উল্লেখ রয়েছে।
শবে বরাতে নবীজির আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন— একদিন গভীর রাত্রে রসুলুল্লাহ সা. নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ পড়ার সময় তিনি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দীর্ঘ সিজদা করেন। এভাবে দীর্ঘ সিজদা করতে দেখে, হযরত আয়েশা রা. এর ধারণা হয়, রসুলাল্লাহ সা. হয়তো নামাজ পড়তে গিয়ে ইন্তেকাল করেছেন।
হযরত আয়েশা রা. তখন তার সন্দেহ দূর করার জন্যে রসুলুল্লাহ সা. বৃদ্ধাঙ্গুলিটি ধরে নাড়া দেন। তাতে রসুলাল্লাহ সা. আঙুল নাড়িয়ে সাড়া দেন। এরপর রসুলাল্লাহ সা. সিজদা থেকে উঠে নামাজ শেষ করে হযরত আয়েশা রা. কে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি ধারণা, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? হযরত আয়েশা রা. তখন উত্তরে বলেন, না, ইয়া রসুলুল্লাহ।
আপনার দীর্ঘক্ষণ সিজদা করা দেখে আমি শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আপনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন? তাই আমি আমার সন্দেহ মেটানোর জন্য আপনার আঙুল নেড়ে, আপনাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম আপনি জীবিত আছেন কি না।
নবীজি তখন আয়েশাকে রা.-কে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি জানো, আজকের রাতটি কী রাত? আয়েশা তখন নবীজিকে বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূলই আমার অপেক্ষা ভালো জানবেন আজেকের রাতটির তাৎপর্য কী?
তখন রাসুলাল্লাহ সা. বললেন, আজকের রাতটি হলো অর্ধ শাবানের রাত। মহান আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তার বান্দার সব প্রার্থনা মনোযোগ সহকারে শোনেন। যারা ক্ষমাপ্রার্থী তাদের পাপ ক্ষমা করে দেন। আর যারা অনুগ্রহপ্রার্থী তাদের অনুগ্রহ করেন, তাদের বরকত প্রদান করেন। আর যারা বিদ্বেষ পোষণকারী, তাদের ক্ষমা না করে তাদের নিজের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।
ইসলাম ধর্মে শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত আনন্দ উৎসব করার জন্য আল্লাহ তায়ালা দেননি। ইবাদতের জন্য দিয়েছেন। শাবান মাস রমজানের আগের মাস। রমজান মাস ছাড়া এ মাসে নবীজি সবচেয়ে বেশি রোজা রেখেছেন।
সাহাবায়ে কেরাম নবীজিকে বললেন আগেকার যুগের উম্মত দীর্ঘ হায়াত বা জীবন পেতো, আমরা তো অল্প কয়েকদিন বাঁচি, তারা ইবাদতের দিক দিয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে যাবেন। তখন নবীজিকে আল্লাহ এমন কিছু রাত দিয়েছেন, এ রাতগুলোতে ইবাদত করলে অনেক সওয়াবের ভাগীদার হওয়া যায়।
এমন কিছু রাতের মধ্যে শবে বরাতের রাত, শবে কদরের রাত, দুই ঈদের রাত ও আশুরার রাত। এ পাঁচ রাতের ইবাদত হাজার রাত ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এভাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শেষ নবীর উম্মতদের অন্যান্য উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।
সুতরাং শবে বরাতের রাতে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে, তাওবা করে গোনাহ মুক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এ রাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত, অতীতের কাজা নামাজ আদায়সহ অন্যান্য জিকির-আজকার করা যেতে পারে। আল্লাহর বিশেষ এ নিয়ামত যেন আমাদের থেকে এমনি এমনি হাতছাড়া না হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ বান্দাদের ওপর দয়া ও ক্ষমার কেবল অসিলা খুঁজে থাকেন। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহগার বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য বিভিন্ন স্থান ও সময়-সুযোগ বাতলে দিয়েছেন, যাতে তার বান্দা নিজ কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, আর আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন।