বাঙালির জীবনে ১৪ এপ্রিল এক বিশেষ দিন—পহেলা বৈশাখ। উৎসব, আনন্দ আর ঐতিহ্যের এক অনবদ্য সংমিশ্রণে সবাই নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেয়। ঢাকার রমনা বটমূল থেকে শুরু করে গ্রামীণ মেলা, পান্তা-ইলিশের আয়োজনে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো দেশ। তবে জানেন কি, এই একই দিনে, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয় নতুন বছর? চলুন, জেনে নিই সেসব দেশের বর্ষবরণের ঐতিহ্য সম্পর্কে-
থাইল্যান্ড — সঙক্রান (Songkran Festival)
থাইল্যান্ডে ১৩-১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় সঙক্রান উৎসব, যা তাদের থাই নববর্ষ। এটি মূলত জলকেলি বা পানি ছোঁড়ার উৎসব হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, একে অপরকে পানি ছিটিয়ে পুরনো বছরের সব দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে ফেলা যায়। থাই সংস্কৃতিতে এই উৎসবের সঙ্গে আছে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানো, বড়দের আশীর্বাদ গ্রহণ এবং পারিবারিক পুনর্মিলন। সারা দেশজুড়ে রঙ, পানি আর আনন্দে ভেসে যায় মানুষ।
লাওস — পি মা লাও (Pi Mai Lao)
লাওসেও ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তিন দিনের নববর্ষ উদযাপন, যাকে বলে পি মা লাও। থাইল্যান্ডের সঙক্রান উৎসবের মতোই এখানে পানি ছোঁড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শহরের রাস্তাঘাটে চলে জমজমাট উৎসব, আর মন্দিরে হয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান।

লাওসের বর্ষবরণের অন্যতম আকর্ষণ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, ছবি: কাম্পা ট্যুর
কম্বোডিয়া — চৌল চনাম থমে (Chaul Chnam Thmey)
কম্বোডিয়ান নববর্ষও শুরু হয় প্রতি বছর ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল। এটি তিন দিনব্যাপী উৎসব, যার নাম চৌল চনাম থমে। উৎসবের প্রথম দিনটি পুরনো বছরের বিদায়, দ্বিতীয় দিন পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং তৃতীয় দিন নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য উৎসর্গিত। কম্বোডিয়ায় এই সময়টায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার, মন্দিরে যাওয়া, ধূপধুনা জ্বালানো এবং পানি দিয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার রীতি প্রচলিত।
মিয়ানমার — থিংয়ান (Thingyan Festival)
মিয়ানমারে ১৩-১৬ এপ্রিল পালিত হয় থিংয়ান নামের বর্ষবরণ উৎসব। এটিও একটি পানি উৎসব, যেটা মূলত ভারতীয় সৌর ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে চলে। থিংয়ান উৎসবে রাস্তায় বিশাল জলযুদ্ধ হয়, আর সঙ্গে চলে ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান, এবং স্থানীয় খাবারের সমাহার।

পারিবারিক মিলন, ঐতিহ্যবাহী খেলা এবং খাবার দিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে শ্রীলঙ্কার বর্ষবরণ উৎসব অলুথ আউরুদ্দ, ছবি: সিনামন ইউ
শ্রীলঙ্কা — অলুথ আউরুদ্দ (Aluth Avurudda)
শ্রীলঙ্কায় ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল পালিত হয় অলুথ আউরুদ্দ, যা সিংহলি ও তামিল জনগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসব। এই উৎসবে রয়েছে সময় নির্ধারিতভাবে রান্না করা, প্রথম পয়সা খরচ, প্রথম ব্যবসা এবং আশীর্বাদ গ্রহণের মতো নানা রীতিনীতি। পারিবারিক মিলন, ঐতিহ্যবাহী খেলা এবং খাবার দিয়ে এ উৎসব হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
বাংলাদেশের বাইরেও মিলছে মিল!
এই সব দেশগুলোর বর্ষবরণের সময়, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় গুরুত্ব একেক রকম হলেও একটি ব্যাপারে চমৎকার মিল পাওয়া যায়—সবই সৌর পঞ্জিকার ওপর নির্ভরশীল এবং সবখানেই উৎসবের মূল ভাষা আনন্দ। ১৪ এপ্রিলের বৈশাখ যেমন বাঙালির হৃদয়ের কাছে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, তেমনি এটি এশিয়ার আরও অনেক মানুষের জন্য নতুন সূর্য, নতুন আশা এবং নতুন শুরুর প্রতীক।
বর্ষবরণ শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানো নয়, এটি হলো স্মৃতি, সংস্কৃতি আর মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন উদযাপনের মুহূর্ত। তাই ১৪ এপ্রিল যখন আপনি ‘শুভ নববর্ষ’ বলবেন, তখন জানবেন — এই উৎসব শুধু আপনার একার নয়, বহু সংস্কৃতির বহু মানুষের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা।