Home বাণিজ্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাশের ওপর তৈরি হচ্ছে সৌদির ‘দ্য লাইন’!

বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাশের ওপর তৈরি হচ্ছে সৌদির ‘দ্য লাইন’!

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮৪ views

সৌদি আরবের মেগা প্রকল্প ‘দ্য লাইন’-এর নির্মাণকাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশের হাজার হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম আইটিভির এক ডকুমেন্টারিতে সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এসেছে।

‘কিংডম আনকভারড: ইনসাইড সৌদি এরাবিয়া’ নামের এ ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রটি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছে। সেখানে এই মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার বিদেশি শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।

তথ্যচিত্রে আইটিভি জানিয়েছে, নিহত শ্রমিকদের অধিকাংশই ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের বাসিন্দা। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্পটিতে কর্মরত শ্রমিকদের দিনে ১৬ ঘণ্টা করে খাটানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছে তারা। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে সৌদি সরকার।

তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বেশি সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক এই প্রকল্পে নিয়োগ করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দ্য লাইনের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন সৌদি প্রধানমন্ত্রী তথা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ। ফলে চরম পরিবেশে জীবন বাজি রেখে দ্রুত গতিতে চলছে নির্মাণকাজ।

 

2 3

ছবি: আইটিভি

 

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে মুখ খুলেছে সৌদি আরবের ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’। এক বিবৃতিতে এই সরকারি সংস্থাটি জানিয়েছে, ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পে বিদেশি শ্রমিকদের মৃত্যু সংক্রান্ত ভুল তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। ভিত্তিহীন পরিসংখ্যান দিয়ে অযথা ভয়ের পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত চলছে। এটি একেবারই কাম্য নয়।

সৌদি সরকারের দাবি, দেশটিতে যেকোনো নির্মাণ প্রকল্পে শ্রমিকদের মৃত্যুর পরিমাণ প্রতি লাখে ১.১২ জন, যা সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরপরও কেন ‘দ্য লাইন’কে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে তদন্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সালমান প্রশাসন।

দেশটির জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কাউন্সিল বিবৃতিতে বলেছে, মানব সমাজের মঙ্গলকামনায় আমরা ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকল্প শুরু করেছি। এতে যারা কাজ করছেন, তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের মৃতদেহের ওপর সৌদি কোনোদিন কোনো নির্মাণকাজ চালায়নি। আর আগামী দিনেও সেটা চালাবে না।

মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের প্রকল্প হল ‘দ্য লাইন’। এই প্রকল্পের অধীনে লোহিত সাগরের তীর থেকে তাবুক প্রদেশের নিয়ম পর্যন্ত লম্বা রাস্তার মতো এলাকায় স্মার্ট সিটি তৈরি করবে রিয়াদ প্রশাসন।

‘দ্য লাইন’ প্রকল্পের জন্য দু’হাতে টাকা খরচ করছে সৌদি প্রশাসন। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ কোটি ডলার। আস্ত একটা শহর গড়ে তুলতে ১৭০ কিলোমিটার লম্বা যে বাড়িটি তৈরি করা হচ্ছে, তাতে থাকবে ৫০০ মিটার উচ্চতার কাচের কাঠামো। সেখানে ব্যবহৃত হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি। এর ভেতরে চলবে না কোনো গাড়ি।

 

3 4

ছবি: আইটিভি

 

২০৩০ সালের মধ্যে ‘দ্য লাইন’ প্রকল্প পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে প্রাথমিকভাবে সেখানে ৯০ লাখ সৌদিবাসী থাকতে পারবেন। এর মধ্যে থাকবে উচ্চগতির রেলপথ। দৈনন্দিন বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা মেটাতে এটি ব্যবহার করবেন সেখানকার বাসিন্দারা।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর একাংশের দাবি, এই প্রকল্প তৈরিতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশটির ইঞ্জিনিয়ারেরা। এতে কিছুটা থমকে আছে নির্মাণকাজ। এ ছাড়া মূল বাজেটের সঙ্গে বর্তমানে নির্মাণ ব্যয়ের মিল না থাকায় প্রকল্পের কাজ পেছাতে  কিছুটা বাধ্য হয়েছে দেশটি।

বার্তাসংস্থা ‘রয়টার্স’ এক প্রতিবেদনে জানায়, সৌদির অর্থনীতিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে ‘ভিশন ২০৩০’র আওতায় ‘দ্য লাইন’ প্রকল্প শুরু করেছেন যুবরাজ সালমান। চলতি বছরের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে নির্মাণকাজে থাকা বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ ৪০ হাজার বলে জানা গেছে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে বিদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর তথ্যচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসায় রিয়াদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সৌদি আরবের নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিমা থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, অত্যধিক গরমের সময়ে তাদের দিয়ে কাজ না করানোর কথাও বলা হয়েছে। আইটিভির তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিদেশি শ্রমিকের একটা বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে।

সৌদি প্রশাসন অবশ্য বলেছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং সৌদি আরবের নিয়ম মেনে ঠিকাদার সংস্থাগুলো ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পে কাজ করছে কি না, তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জীবন ও কাজের পরিবেশ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও কেন এই অভিযোগ উঠছে তা বুঝতে পারছি না।

 

4 1

ছবি: আইটিভি

 

যুবরাজ সালমানের স্বপ্নের এই প্রকল্পে একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা কাজ করছে। যার মধ্যে জেকব্‌স, এইকম, বিচটেল, কেলার, উইবিল্ট, এজিস, টার্নার অ্যান্ড টাউনসেন্ড, আর্চিরোদন ও ডেমে উল্লেখ্যযোগ্য। কোনো নির্দিষ্ট ঠিকাদার সংস্থার শ্রমিকেরা নিহত হয়েছেন কি না, তা তথ্যচিত্রে উল্লেখ করা হয়নি।

এই বিষয়ে দাস-বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবের রাজপরিবারের দাস ব্যবহার করার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। টাকার লোভে এই প্রকল্পে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল বা আফ্রিকার বাসিন্দাদের কাজ করানো খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে একুশ শতকে অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। আর তাই এ ব্যাপারে প্রমাণ ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।

লোহিত সাগরের তীর থেকে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সৌদি প্রশাসন। ফলে সেখানে নির্মাণকাজ চালানো এমনিতেই চ্যালেঞ্জের। এ কারণে শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়টিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের মুখরক্ষা করতে সালমান প্রশাসন মৃতদেহ গুম করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ