বেশ কিছুদিন ধরেই ডিমের বাজারে চরম অস্থিরতা চলছে। খামারি, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে এর পেছনে মূলত ৫টি কারণ রয়েছে। প্রথমত: বাজার সিন্ডিকেটের নানা কারসাজি, দ্বিতীয়ত: উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও সরবরাহ-সংকট, তৃতীয়ত: খাবার ও বাচ্চার দাম বাড়ার কারণে অসংখ্য খামার বন্ধ, চতুর্থত: আবহাওয়াজনিত কারণে উৎপাদনে ঘাটতি, পঞ্চমত: দেশের একটি বড় অংশে বন্যার কারণে খামার ভেসে যাওয়া।
রাজধানীতে আজ মঙ্গলবার ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন (১২টি) ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা দরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ৮ আগস্ট ডিমের দাম ছিল ডজনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬২ টাকা। ২০২২ সালের আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ডিমের দাম বাড়ছিল। ধাপে ধাপে বেড়ে তা ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। কখনো কখনো তা ওঠে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। এর আগে বছরজুড়ে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত।
ডিমের দামের অস্থিরতার কারণ হিসেবে ‘সিন্ডিকেটের’ কারসাজির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের আলোচনা আছে দীর্ঘদিন ধরেই। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। কারসাজির মাধ্যমে ডিমের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় ছয়টি কোম্পানি ও চারটি বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনের (সমিতি) বিরুদ্ধে মামলা করে এই কমিশন। কিন্তু মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারায় ডিমের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চার-পাঁচ দিন ধরে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিম কিনতে ১৮০-১৯০ টাকা লাগছে। অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে বিদেশ থেকে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পাশাপাশি দাম কমাতে বাজারে অভিযানে নেমেছে সরকার। কিন্তু তাতে দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু কিছু পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ অথবা কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বরং সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
কারসাজিতে যারা জড়িত:
দেশের ১০টি পোল্ট্রি ফার্ম ও পোল্ট্রি সংশ্লিষ্ট সংগঠনের বিরুদ্ধে ডিমের দাম বৃদ্ধিতে কারসাজির অভিযোগে মামলা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড, পিপলস পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, নাবা ফার্ম লিমিটেড, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ফার্ম প্রোটেকশন ন্যাশনাল কাউন্সিল, পোল্ট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্ট।
বিসিসি সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান তাদের ডিমের দাম বাড়িয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে।
এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় এলাকায় বড় বড় আড়তদাররা ডিমের দামের কারসাজিতে জড়িত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগে প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ কয়েকটি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে ও দোষীদের শাস্তি না হলে যেকোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব হবে না এবং ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়বে। এবার কমিশন মামলাগুলো দ্রুত শুনানি করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ঢাকা কেন্দ্রিক একটি গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এর সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা পায় না। ক্রেতাদের বাড়তি দামে ডিম খেতে হয়। বাড়তি মুনাফার টাকা যায় সিন্ডিকেটের পকেটে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেওয়া দাম অনুসারে, উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের মূল্য ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হওয়ার কথা ১৪২ টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করেছিল। নির্ধারিত দর বাস্তবায়ন করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে।
এদিকে অভিযানের ভয়েই ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে ডিমের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জরিমানার অজুহাতে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের আড়তদাররা।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ আমান বলেছেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে একটা রেট বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা নির্ধারিত দামে ডিম কিনতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা গাড়ি বন্ধ করে রেখেছি। তিনি বলেন, তেজগাঁওয়ে দৈনিক ১৪-১৫ লাখ ডিম আসে। ঢাকায় ডিমের চাহিদা এক কোটি। তেজগাঁওয়ের বাইরে কিছু জায়গায় অনেকে ঠিকই উচ্চ দামে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু আমাদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছি আমরা।
এদিকে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খামারিরা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ-সংকটকে দায়ী করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই দুটি সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ৮ অক্টোবর সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুটি কাজ করা জরুরি। প্রথমত, এখন স্বল্প মেয়াদে ঘাটতি মেটাতে ডিম আমদানি করতে হবে। আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুল্কছাড় দেওয়া হয়নি। সরকার শুল্কছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমদানিকারক পর্যায়ে খবর ছড়িয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশে খরচ এত বেশি কেন, সেটা পর্যালোচনা করে বাজারকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পোলট্রি খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে দাম কমানো দরকার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার ৩৭৫ কোটি পিস ডিমের উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের একটি সংস্থা। এক পিস ডিম উৎপাদনে খরচ দেখানো হচ্ছে প্রায় ১১ টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ। সরকারের আরেকটি সংস্থার তথ্যমতে, দৈনিক উৎপাদনের তথ্যগুলো দৈনিক ভোগের তুলনায় বেশি দেখানো হচ্ছে। ফলে ডিমের উৎপাদন ও খরচের তথ্য অতিরঞ্জিত ও অতিমূল্যায়িত।
এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ-সংকট বড় কারণ। দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আগে দিনে সাড়ে চার-পাঁচ কোটির মতো ডিম উৎপাদন হতো। এখন তিন কোটির বেশি উৎপাদন নেই। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।
কারওয়ান বাজার পরিদর্শনে গিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা গত সোমবার আরও বলেন, ডিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা গত দুই দিনে বসেছি। এ সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গেও বসা হবে। পাশাপাশি ভারত থেকেও ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাজার স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টায় কোনো গাফিলতি নেই।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিমের চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া এখন বাজারে সব ধরনের শাকসবজির দাম চড়া। ফলে চাপ পড়েছে ডিমের ওপর। তবে প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়াচ্ছেন। করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের আধিপত্যের কারণে ডিমের বাজারে এই অস্থিরতা।