প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। তারা নির্দিষ্ট মৌসুমে ঠাণ্ডা অঞ্চল ছেড়ে উষ্ণ অঞ্চলে যায়, আবার মৌসুম বদলালে ফিরে আসে নিজ দেশে। এই চ্যালেঞ্জিং যাত্রায় তাদের কাছে না থাকে কোনো মানচিত্র, না থাকে কোনো গাইড। এত দীর্ঘ পথ তারা কীভাবে সঠিকভাবে পাড়ি দেয়? এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে।
নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, এই পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড অনুভব করতে পারে এবং এই কাজে তারা ব্যবহার করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এক জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া।

কানাডিয়ান গিজ, ছবি: অল এবাউট বার্ডস
চৌম্বক ক্ষেত্র ও পাখির চোখের রহস্য
১৯৭৮ সালে জীবপদার্থবিদ ক্লাউস শুলটেন এবং তার সহকর্মীরা প্রস্তাব করেন যে, পাখির চোখে ক্রিপ্টোক্রোম নামক এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন সূর্যের আলো শোষণ করে এবং এতে ইলেকট্রনের (এক ধরনের কণিকা) গতিবিধি শুরু হয়। তৈরি হয় ফ্রি র্যাডিক্যাল জোড়া, যা দুটি ইলেকট্রনের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
ইলেকট্রনের স্পিন বা ঘূর্ণন কোণ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে, পাখির চোখে একটি বিশেষ ধরণের সংকেত তৈরি হয়, যা তারা অনুভব করতে পারে। এই সংকেত ব্যবহার করেই পাখিরা দিক নির্ধারণ করে এবং সঠিক পথে এগিয়ে যায়। বলা যায়, এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক ‘জীবন্ত কম্পাস’ যা জন্ম থেকেই পাখিদের থাকে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে কাজ করে?
কোয়ান্টাম মেকানিক্স হলো পদার্থবিজ্ঞানের এক শাখা, যেখানে অতি ক্ষুদ্র কণিকাদের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়। পাখির চোখের ফ্রি র্যাডিক্যাল জোড়ার ইলেকট্রনের আচরণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম মেনে চলে। সাধারণভাবে আমরা চৌম্বক ক্ষেত্র চোখে দেখতে পারি না, কিন্তু পাখিরা এই কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা দেখতে বা অনুভব করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম – সব দিক বুঝতে পারে।

ফ্রান্সে দক্ষিণ দিকে অভিবাসনের সময় বিদ্যুৎ লাইনের উপর এক ঝাঁক শস্যাগার গিলে, ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
গবেষণায় দেখা গেছে যে ৯৫% পরিযায়ী পাখি রাতে, একা এবং পিতামাতার নির্দেশনা ছাড়াই ভ্রমণ করে, তাই আচরণটি অবশ্যই আংশিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। জার্মানির ইনস্টিটিউট অব এভিয়ান রিসার্চের পরিচালক মিরিয়াম লিডভোগেল বলেন, ‘পরিযায়ী পাখিরা বেশিরভাগ সময় রাতের অন্ধকারে একা একা ভ্রমণ করে। তাদের এই পথ খুঁজে নেয়ার ক্ষমতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র দেখতে পায় না, কিন্তু অনুভব করতে পারে। এটি তাদের পথচলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।’
ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির সম্ভাবনা
পাখিদের এই কোয়ান্টাম দক্ষতা শুধু তাদের অভিবাসনের রহস্যই উদঘাটন করেনি, বরং ভবিষ্যতে মানুষের তৈরি নেভিগেশন সিস্টেম বা সেন্সর উন্নয়নের নতুন পথও খুলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া অনুকরণ করে এমন প্রযুক্তি তৈরি করা যাবে, যা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দিক নির্ধারণ করতে পারবে।
চোখের ভিতরে ঘটে যাওয়া এই অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সত্যিই অবাক করার মতো। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে তারা যে দক্ষতার সঙ্গে পথ খুঁজে নিতে পারে, তা শুধু প্রকৃতির এক বিস্ময় নয়, বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও এক মূল্যবান অনুপ্রেরণা।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান