Home টপ পোস্ট অফশোর ব্যাংকিংয়ের আদ্যোপান্ত

অফশোর ব্যাংকিংয়ের আদ্যোপান্ত

ইকবাল হোসেন
১২৭ views

অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। প্রচলিত ব্যাংকিং বা শাখার কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্ন অফশোর ব্যাংকিং। এ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিতরণ করা হয়। এ ধরনের ইউনিটকে সংক্ষেপে বলা হয় ওবিইউ। আর আমরা দেশের ভেতরে বিভিন্ন শাখা থেকে যে ঋণ নিই, আমানত রাখি বা অন্য বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা নিই, তাকে বলা হয় ডমেস্টিক ব্যাংকিং ইউনিট (ডিবিইউ)। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আলাদা লাইসেন্স নিয়ে একই শাখায় অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারে। 

অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার দুটোই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া হয়। এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে।

বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ দেয়া ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকের কোনো নিয়ম – নীতিমালা প্রয়োগ করা হয় না। আলাদা আইনকানুনের মাধ্যমে এ তহবিল পরিচালিত হয় ও হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল মুনাফায়। অফশোর ইউনিট থেকে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে। এটি এমন ব্যাংকিং কার্যক্রমকে নির্দেশ করে যা শুধুমাত্র অনিবাসীদের যেমন: মাল্টিন্যাশনাল পণ্য, সেবা এবং ফাইন্যান্সারদের সম্পৃক্ত করে। এটি দেশীয় ব্যাংকিংয়ের সাথে যুক্ত হয় না।

কারা হিসাব খুলতে পারবেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যে কোনো বাংলাদেশি, বিদেশি নাগরিক, দেশ-বিদেশে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে অনুমোদিত ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে হিসাব খুলতে পারবে। মার্কিন ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানিজ ইয়েন, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, সুইস ফ্রাঁ, চায়নিজ ইউয়ান ও সিঙ্গাপুর ডলারে লেনদেন করা যাবে। বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা যে কোনো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই হিসাবে জমা করা যাবে। 

আইনে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিংয়ে জমানো অর্থের বিপরীতে যে সুদ আয় হবে, সেখানে কোনো কর দিতে হবে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে এই আমানতের বিপরীতে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। এতে করে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ কমবে, তাতে করে বেশি সুদ দিতে পারবে ব্যাংক। সব মিলিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংক এ ধরনের তহবিলে উৎসাহিত হয়ে ডলার প্রবাহ বাড়াবে।

প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশিদের জন্য বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রায় প্রধানত দুই ধরনের অর্থাৎ চলতি অ্যাকাউন্ট ও বিভিন্ন মেয়াদের ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট চালু রয়েছে। চলতি অ্যাকাউন্টের মধ্যে রয়েছে ফরেন কারেন্সি ও ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং। আর বিভিন্ন মেয়াদের ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট রয়েছে। 

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অফশোর ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, যে কোনো অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই এ সুবিধা নিতে পারেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নন, এ রকম বিদেশি নাগরিকরাও অ্যাকাউন্ট খুলছেন। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে বসবাস করেন। তাদের একটি অংশ অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশে আমানত রাখলে কয়েক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও যে কোনো অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। 

অফশোর ব্যাংকিং প্রডাক্টের মাধ্যমে আমানতের বিপরীতে ভালো মুনাফা ছাড়াও আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। একজন গ্রাহক পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে সহজে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

অফশোর ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য আরএফসিডি নামে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব পরিচালনার সুযোগ আছে। যে কোনো বাংলাদেশি প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণ শেষে আরএফসিডি হিসাবে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত জমা রাখতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এখানেও মুনাফা ও সুযোগ-সুবিধার বাড়িয়েছে। 

অফশোর ব্যাংকিং আইনে বলা হয়েছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কের শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট আমানত গ্রহণ করতে পারবে। পাশাপাশি তাদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ও অগ্রিম বা বিনিয়োগ, ঋণপত্র ও গ্যারান্টি সুবিধা প্রদান, বিল ডিসকাউন্টিং, বিল নেগোশিয়েটিং এবং অন্যান্য বৈদেশিক বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট বহিঃলেনদেন সেবা দিতে পারবে। অনিবাসী বাংলাদেশি, বিদেশি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট আমানত ও ঋণ গ্রহণ করতে পারবে।

osb1

ছবি: চার্টার্ড জার্নাল

অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে সংশ্লিষ্ট তফসিলি ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদিত নীতিমালা থাকতে হবে। তফসিলি ব্যাংকের অফশোর কার্যক্রমের জন্য পৃথক হিসাবপত্র সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদনে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে তহবিল স্থানান্তর করা যাবে।

আপনি বাংলাদেশি, কিন্তু বিদেশে থাকেন। আপনি এখন চাইলে বিদেশে থেকেই দেশের ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারেন। আবার আপনি বিদেশে অবস্থান করলেও আপনার পক্ষে নিকটাত্মীয় এমন হিসাব খুলতে পারছেন। এটি ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং বা অফশোর ব্যাংকিং হিসাব নামে পরিচিত। বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এই হিসাবে যে মুনাফা দিচ্ছে, তা অনেক দেশের চেয়ে বেশি।

ব্যাংকগুলো সূত্রে আরও জানা গেছে, অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে বিদেশি মুদ্রায় আমানত রাখার পর যে মুনাফা মিলছে, তার পুরোটাই আয়করমুক্ত। এই অর্থ নিয়ে দেশের কোনো সংস্থা প্রশ্নও করছে না। যেকোনো প্রয়োজনে মুনাফাসহ পুরো জমানো অর্থ আমানতকারী তার অবস্থান করা দেশে নিতে পারছেন।

অফশোর ব্যাংকিং হিসাব খোলায় এখন জোর দিচ্ছে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক। ফলে দিন দিন ব্যাংকগুলোতে প্রবাসীদের এই হিসাব খোলা বাড়ছে। 

যেভাবে হিসাব খুলবেন
ডলার–সংকটের মধ্যে গত বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এই হিসাব খোলার সুযোগ দিয়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ে হিসাব খুলতে ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। বিদেশে বসেই ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটে ঢুকে এই হিসাব খোলা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জমা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি বিদেশে থাকার প্রমাণপত্র ও কাজের পরিচয়পত্র। সঙ্গে দিতে হচ্ছে ছবি। দেশে যদি কেউ প্রবাসীর পক্ষে এই হিসাব পরিচালনা করেন, সে ক্ষেত্রে তার বিস্তারিত তথ্যও জমা দিতে হয়।

যেহেতু বিদেশে অবস্থানরত কারও পক্ষে তার বাংলাদেশি নিকট আত্মীয় এই হিসাব খুলতে পারেন, তাই এ–সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দিতে হবে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশির পক্ষে দেশে যিনি এই হিসাব খুলবেন, তার সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। দুজনকেই পরিচয়পত্র, ছবি ও অন্যান্য নথি জমা দিতে হবে। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট বা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট লিখে ওয়েবসাইটে সার্চ করলেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যাচ্ছে।

যেসব সুবিধা মিলছে
অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে কত মুনাফা দেওয়া যাবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন বার্ষিক ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দিচ্ছে। বিদেশি ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে সুদ মিলছে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে প্রবাসীদের জন্য এই ব্যাংক হিসাব বাড়তি মুনাফা পাওয়ার উপায় হয়ে উঠেছে।

কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) না থাকলে বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় খোলা হিসাবে গচ্ছিত আমানত থেকে অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে দিতে হয় ১০ শতাংশ কর। তবে অফশোর ব্যাংকিং হিসাব থেকে অর্জিত মুনাফার ওপর কোনো কর দিতে হয় না। ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪’–এ অনুসারে, জমা করা অর্থের উৎস নিয়ে কোনো সংস্থা প্রশ্ন করছে না। যেকোনো সময়ে মুনাফাসহ পুরো অর্থ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলায় যাতে প্রবাসীদের আগ্রহ বাড়ে, সে জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) ইতিমধ্যে বিদেশে গিয়ে প্রচারণাও চালিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বলা হয়েছে যে অফশোর ব্যাংকিং, বিদেশফেরতদের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খোলা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ কমবে ও রিজার্ভ বাড়বে।

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ