Home রাজনীতি আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১১৮ views

অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল মূলত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, বিকাশমান মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্ক্ষাকে রূপ দিতে। 

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ [উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।

তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোন অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান।

সেখানেই ২৩শে জুন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

রোজ গার্ডেন ১৯৪৯ সালে এই ঐতিহাসিক ভবনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় 1
রোজ গার্ডেন। ছবি: বিবিসি

নবগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যারা ছিলেন    
নতুন দল গঠনের পর মওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেয়া হয় একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করার জন্য। তিনি অন্যদের সাথে পরামর্শ করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন। 

সেই নতুন কমিটির সভাপতি হলে মওলানা ভাসানী। সহ-সভাপতি হলেন আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান। সাধারণ সম্পাদক হলেন শামসুল হক। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান, যার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে প্রথম সভার আয়োজন হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

এভাবেই প্রথম ৪০ জনের কমিটি গঠিত হয়। তবে পরবর্তীতে তাদের অনেকে আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকেননি। পরের দিন, ২৪শে জুন আরমানিটোলা ময়দানে একটি জনসভা ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগের কর্মীরা সেই সভায় হামলা করেছিলেন।

লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ”অলি আহাদের বইতে একটি ভাষ্য পাওয়া যায় যে, রোজ গার্ডেনের সভায় কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন এ কে ফজলুল হক। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন (বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল পদ)। কিন্তু সরকারি পদে থাকার কারণে তিনি কিছুক্ষণ পরেই সেখান থেকে চলে যান।”

মুসলিম শব্দটি যেভাবে বাদ দেয়া হয়   
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ”দলের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় পরবর্তীতে কেউ কেউ আপত্তি করছিলেন। এ নিয়ে দলে বেশ একটি বিরোধ তৈরি হয়েছিল, যে মুসলিম শব্দটি থাকবে নাকি থাকবে না।” 

তখন হিন্দু এবং মুসলিম আসনে আলাদাভাবে নির্বাচন হতো। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, এই দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে। ওই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় যুক্তফ্রন্ট, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ”যদিও মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য জোর দিচ্ছিলেন, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুন। কারণ তার ভয় ছিল, এটা বাদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।’’

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগে যে কাউন্সিল হয়, সেখানে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ফলে অমুসলিমরাও এই দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পান। তবে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে।

‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এই শব্দগুচ্ছে ‘মুসলিম’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হোক এটা তখন অনেকেই চাননি। বঙ্গবন্ধুও চাননি, এটা পরিষ্কার তার এই মন্তব্যে : ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু মেনিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন, তারা চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২১)।
তথ্যসূত্র: লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ, বঙ্গবন্ধুরঅসমাপ্ত আত্মজীবনী ও লেখক ও কলামিস্ট চিররঞ্জন সরকার

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ